অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ (১৯২২–২০০৩)
সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক ঘটনা নিজের ডায়েরিতে লিখে গেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। বিশেষ করে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নিয়ে কমিটির সদস্যরা কী ধরনের বিতর্ক করেছেন এবং মতামত দিয়েছেন, তাও লিখে গেছেন মোহাম্মদ খালেদ। সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনি কতটা ‘সিরিয়াস’ ও আন্তরিক ছিলেন, সেটি জানা যাচ্ছে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের বয়ানে। তিনি লিখেছেন, ‘অনেক সময়ে যে ধ্যান ধারণা, মত বা পন্থা জনপ্রিয় ছিল, তার বিরুদ্ধেও মোহাম্মদ খালেদ সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছেন। তবে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে নিয়েছেন। নিজের মত প্রকাশ করে বিবেককে শান্ত করেছেন। কিন্তু জিদ করে সেই মত ধরে বসে থাকেননি। অন্যরা যখন তার মত গ্রহণ করেননি, তখন বৃথা তা নিয়ে আর তর্ক করেননি। নিজে সৎ ও বিশ্বস্ত ছিলেন বলে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ অন্যের সততা ও বিশ্বস্ততায় আস্থা রাখতেন।’ (মোহাম্মদ খালেদ, রাশেদ রউফ, বাংলা একাডেমি/২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৫)।
রূপসী বাংলার কবিখ্যাত জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার লাইন:
‘মানুষের হাতে আজ মানুষ হতেছে নাজেহাল
পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।’
খ্যাতিমান সাংবাদিক, চট্টগ্রামের জনপ্রিয় সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর সম্পাদক, বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সঙ্গে জীবনানন্দের ওই কবিতার লাইনটি মিলে যায়। একটা ‘বিশুদ্ধ চাকরি’ বা কাজের জন্য জীবনানন্দ যেমন সারা জীবন হাঁসফাঁস করেছেন, অস্থির ছিলেন—মোহাম্মদ খালেদও সেরকম আজ শিক্ষকতা, কাল ব্যবসা, পরশু ব্যাংকের চাকরি, তারপর সাংবাদিকতা এবং তার মধ্যে রাজনীতি করে করে অবশেষে বুঝতে পারলেন সাংবাদিকতাই হচ্ছে তাঁর ‘বিশুদ্ধ চাকরি’ বা উপযুক্ত কাজ।
কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়। তারপর আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ওই সময়ের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ সদস্য। তারপর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ৩৪ সদস্যের ওই কমিটির অধিকাংশই ছিলেন আইনের ছাত্র। কয়েকজন ছিলেন ব্যতিক্রম। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ তাঁদের অন্যতম।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে মোহাম্মদ খালেদ কার্যত রাজনীতিতে আর সক্রিয় থাকেননি। পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন সাংবাদিকতায়। প্রসঙ্গত, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে চারজন সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। মোহাম্মদ খালেদ ছাড়া বাকি তিনজন হলেন বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী শামসুদ্দীন মোল্লা (দৈনিক ইত্তেফাকের ফরিদপুর সংবাদদাতা), লুৎফর রহমান (দৈনিক সংবাদের গাইবান্ধা সংবাদদাতা) এবং শওকত আলী খান (সাপ্তাহিক জনতার সম্পাদক) ।
জন্ম, শিক্ষা ও বেড়ে ওঠা
মোহাম্মদ খালেদের পৈতৃক আবাসভূমি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে। কিন্তু তাঁর জন্ম ভারতের বিহার প্রদেশের রাজধানী পাটনায়, ১৯২২ সালের ৬ জুলাই। বাবা আবদুল হাদী চৌধুরী তখন বিহার সরকারের অধীনে পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের রেজিস্ট্রার। সস্ত্রীক বসবাস করতেন পাটনায়।
জন্মের পর বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত মোহাম্মদ খালেদ কাটিয়েছেন পাটনায়। বাবার চাকরিস্থলে অনেকের মতো তাঁরও শৈশব ছিল বর্ণিল। বড় বাংলোতে থাকতেন। সামনে ছিল বড় আঙিনা। আঙিনাজুড়ে ফুল ও ফলের বাগান। সেখানে খেলতেন বন্ধুদের নিয়ে। কাছেই রেলস্টেশন। প্রায়ই চলে যেতেন সেখানে। একসময় তাঁরা পাটনার সেই বড় বাংলো ছেড়ে স্থায়ীভাবে সপরিবারে চলে আসেন গ্রামে রাউজানের সুলতানপুরে।
মোহাম্মদ খালেদের ভাষায়: ‘বাল্যকালে গ্রামের পরিবেশ থেকে যে শিক্ষা আমি পেয়েছি, তা আজও আমার মাঝে বিরাজিত। আমি দেখেছি মানুষের সরলতা, মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐক্য। সে শিক্ষা আমাকে সমাজ জীবনে চলতে শিখিয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশের অন্যান্য গ্রামের মতো আমার গ্রামেরও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু একান্তে যখন ভাবি, তখন শৈশব, শৈশোর ও যৌবনের গ্রামকেই চোখের ওপর ভাসতে দেখি।’
মোহাম্মদ খালেদের প্রথম পাঠ তাঁর পরিবারে। মা-বাবার কাছে। তারপর যখন স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়, তখন তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় পাটনার একটি স্কুলে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর বাবা সপরিবারে চলে আসেন চট্টগ্রামে। ভর্তি করা হয় রাউজান আর. আর. এ. সি স্কুলে। স্কুলটির পুরো নাম রামগতি-রামধন আবদুল বারী চৌধুরী ইনস্টিটিউশন।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহ ও উপস্থিতির কারণে তিনি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় তিনি নাট্যাভিনয় ও আবৃত্তিতে বিশেষ পারদর্শিতা দেখান। খেলাধুলার আয়োজনেও তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯৪০ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৪২ সালে আই.এ পাস করেন। ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন । এজন্য ওই বছর ঢাকায়ও গিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকায় তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছিল। তাই চট্টগ্রামে ফিরে বাবাকে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে জানান যে তিনি ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান। বাবা তাঁর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিলেন এবং তাঁর জন্য মাসিক ৭৫ টাকা বরাদ্দ করেন। একসময় আলিগড়ের উদ্দেশে রওনা হলেন। তখন চলছিল ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। তিনি যখন আলিগড়ে পৌঁছালেন ততদিনে সেখানে ভর্তি শেষ হয়ে গেছে। ফলে আর ভর্তি হতে পারেননি। সময় নষ্ট না করে ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন সেখানকার ছাত্র।
ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় মোহাম্মদ খালেদের বাবা মারা যান। চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে পুনরায় ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আবার কলকাতায়। সেখানে গিয়ে এম.এ পড়ার উদ্যোগ নেন। যদিও বাবার মৃত্যুর কারণে সংসারে আর্থিক সংকট দেখা দিলে ছাত্র অবস্থাতেই খালেদকে নানারকম কাজ করতে হয়।
ইচ্ছে ছিল অর্থনীতিতে এম.এ পড়বেন। সেজন্য ভর্তি হতে গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন প্রফেসর বেনীমাধব বড়ুয়া জানালেন যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আজিজুল হক মুসলিম ছাত্রদের জন্য সেখানে ইসলামের ইতিহাস নামে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ খুলেছেন। প্রফেসর বেনীমাধবের পরামর্শে মোহাম্মদ খালেদ ভর্তি হন ইসলামের ইতিহাসে। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এম.এ পাস করেন। ওই সময় তাঁর পড়ালেখায় সহায়তা করতেন মামা এবং পরবর্তীকালে তাঁর শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক—মূলত যাঁর কারণেই মোহাম্মদ খালেদ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন
রাশিয়া সফরকালে মস্কো ঘণ্টার সামনে মোহাম্মদ খালেদ
১৯৪৭ সালে এম.এ পাস করার পর মোহাম্মদ খালেদ কর্মজীবনে মনোনিবেশ করেন। চট্টগ্রাম শহরের মোমিন রোডে ‘ফ্রেন্ডস স্টোর’ নামে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চালু করেন। এর পাশাপাশি বাঁশ ও বেতের ফার্নিচারের ব্যবসা শুরু করেন। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য না পাওয়ায় খুঁজতে থাকেন নতুন ব্যবসা, নতুন কর্মক্ষেত্র। নেমে পড়েন ক্লিয়ারিং-ফরওয়ার্ডিং ব্যবসায়। খাতুনগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন ‘এম খালেদ’ নামে একটি ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্সি। কিন্তু সেখানেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি।
এরপর শিক্ষকতা শুরু করেন নাজিরহাট কলেজে। কর্মজীবন নিয়ে স্মৃতিকথায় অধ্যাপক খালেদ লিখেছেন: ‘ছাত্রজীবন থেকেই উপার্জনের পথ খুঁজতে হয়েছে। শিক্ষাজীবন শেষ করে বিভিন্ন ব্যবসায় হাত দিয়েছি কিন্তু ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন হয়নি। দোকানদারি, ক্লিয়ারিং ব্যবসা সবই করেছি। জাহানপুর স্কুলে ২০/২৫ দিন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছি। আবার সব ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় এসেছি। আবার নাজিরহাট কলেজে অধ্যাপনা করেছি। অধ্যাপনাই ছিল দীর্ঘদিনের চাকরিকাল। পরে তাও ছেড়ে দিয়েছি। এর আগে অবশ্য রাউজান স্কুলেও শিক্ষকতা করেছি। এরপর স্বজনদের অনুরোধে আন্দরকিল্লা টাউন কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকরি করেছি।’
মোহাম্মদ খালেদ গ্রিনলেজ ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট বিভাগে অফিসার হিসেবেও যোগদান করেছিলেন। এর মধ্যে আসে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে তিনি নির্বাচনি প্রচারে নেমে যান। নির্বাচনের ৪ মাস পর অফিসে গিয়ে জানতে পারেন কর্তৃপক্ষ তাঁকে লন্ডনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করেছিলো। কিন্তু অনুপস্থিতির কারণে তিনি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এরপর মোহাম্মদ খালেদ আবারও শিক্ষকতায় ফিরে যান এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
সাংবাদিক মোহাম্মদ খালেদ
দৈনিক আজাদীর সাংবাদিকদের সঙ্গে মোহাম্মদ খালেদ
১৯৫৮ সালে আইউব খান সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করলে সারা দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক তখন নিজের মেয়ের জামাই মোহাম্মদ খালেদকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। উপরন্তু তিনি তখন বেকার। আব্দুল খালেক তখন ‘কোহিনুর’ ইলেকট্রিক প্রেস পরিচালনা এবং সেখান থেকে বই পুস্তক প্রকাশ করছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো মাসিক ‘কোহিনুর’। কিন্তু আব্দুল খালেকের একার পক্ষে সব দিক দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। মোহাম্মদ খালেদ তখন শ্বশুরের সঙ্গে কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে কাজ শুরু করেন।
১৯৫০ সাল থেকে থেকে ‘কোহিনূর’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। আব্দুল খালেকের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল চট্টগ্রাম থেকে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করবেন। কিন্তু সময় ও সুযোগ হচ্ছিল না। ‘কোহিনূর’ প্রেসে মোহাম্মদ খালেদের কাজ দেখে তিনি বুঝতে পারেন, খালেদ এতদিন পর তাঁর নিজের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাজ পেয়েছেন। একদিন তাঁকে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে মোহাম্মদ খালেদ তাঁকে অভয় দেন। পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক আজাদী’। আর এই পত্রিকার মাধ্যমে ঘুরে যায় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জীবনের মোড়। পুরোপুরি যুক্ত হয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের মৃত্যুর পরে দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। ১৯৬২ থেকে আমৃত্যু তিনি আজাদীর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আজাদী প্রকাশনার গোড়ার দিকে তিনি বলতে গেলে চব্বিশ ঘন্টাই পত্রিকার পেছনে থাকতেন। কোহিনুর প্রেসের দোতলাটি তাঁর ঘরবাড়ি। নিজের পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর ফুরসৎ পেতেন না। বর্তমানের মতো আধুনিক প্রযুক্তির চল তখন ছিল না। হ্যান্ড কম্পোজে ম্যাটার প্রস্তুত করতে হতো। কম্পোজ করতে করতে সকাল হয়ে যেতো আর পত্রিকা মুদ্রণে যেত প্রায় সময়ই সকাল সাত/আটটায়। এসব কিছু দেখাশোনা করতে করতে পরের দিনের পত্রিকা ম্যাটার প্রস্তুত করতে হতো। অধ্যাপক খালেদ যেহেতু সম্পাদক তাই সবকিছুর তদারকি তাঁর হাতে। (সিদ্দিক আহমেদ, চেতনার বাতিঘর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ/২০২২, পৃষ্ঠা ১৭১)।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একজন আদর্শবান সাংবাদিক। সাংবাদিকতার নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। পরমতসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সংবাদ-প্রতিবেদন আর সম্পাদকীয় মন্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার দুরূহ কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদন করেছেন। সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে তিনি যেমন সত্যনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করেছেন, তেমনি সম্পাদকীয় নীতিতে দেশের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্কের নীতির সম্মানজনক সঙ্গতি রক্ষা করেছেন। সংবাদ প্রতিবেদনে যার যা প্রাপ্য কিংবা পাওয়া উচিত, তা তিনি অকৃপণভাবে দিয়ে গেছেন এবং এর পাশাপাশি সম্পাদকীয় মন্তব্যে বিষয় কিংবা ঘটনাবিশেষের মূল্যায়নপূর্বক নির্দেশনা দিয়েছেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বহু ঝক্কি-ঝামেলা ও ধাক্কা সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতা পেশায় তিনি ছিলেন সফল সৈনিক। নীতির ব্যাপারে ও সত্যানুসন্ধানে তিনি ছিলেন আপসহীন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে কোনো নীতি- বিবর্জিত কর্মে তিনি লিপ্ত হননি। সত্য ও ন্যায়ের দৃঢ় সমর্থক হিসেবে কাজ করেছেন। আদর্শ ও পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। প্রয়াত সাংবাদিক নজির আহমদ তার স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বলেন, “১৯৬১-১৯৬২ সালেই দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৬২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে.জে. আজম খান জামালখান এলাকায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তারপর অধ্যাপক খালেদসহ অন্যান্যের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অবশ্য চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রথম কার্যকরী কমিটি বা আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়েছিল তখনকার জেলা প্রশাসক কাজী জালাল উদ্দিনকে আহ্বায়ক ও জেলা গণসংযোগ অফিসার একরামুল করিমকে সদস্য-সচিব করে। চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও অধ্যাপক খালেদ সক্রিয় ছিলেন। অন্যান্যের সাথে তিনিও ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। তখন সাংবাদিক ইউনিয়নে সদস্য সংখ্যা ছিল তিরিশের নিচে।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব তার অবদানের কথা স্মরণ করে ২০১১ সাল থেকে ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা’ প্রবর্তন করেছে। প্রতি বছর একটি বিষয় নির্ধারণ করে তার জন্মদিন উপলক্ষে এ স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রথম বছর ২০১১ সালে স্মারক বক্তৃতা দেন কবি-সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন, দ্বিতীয়বার ২০১২ সালে বক্তৃতা দেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কামাল লোহানী, ২০১৩ সালে বক্তৃতা প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং ২০১৪ সালে এ বক্তৃতা দেন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন।
রাজনৈতিক জীবন
চট্টগ্রামের রাউজান কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধুকে সোনার নৌকা উপহার দিচ্ছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন মোহাম্মদ খালেদ। ১৯৪০ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ওই সময় প্রতিষ্ঠা করেন রাউজান ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশন। এ অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মোহাম্মদ খালেদ নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তখন রাউজানে বিদ্যুৎ যায়নি। দারোগা বাড়ির বিস্তৃত উঠোনে সন্ধ্যায় গ্যাস লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করা হতো।
তখন থেকে ভারতের মুসলিম ছাত্র-জনতা টেকনাফ থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত একটি স্লোগান নিয়ে সংগ্রামে নামে। সেটি হলো ‘ভারত বিভাগ চাই’। মোহাম্মদ খালেদ এ আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। পরবর্তীকালে তিনি যখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বি.এ শ্রেণিতে পড়ার জন্য ভর্তি হন, তখন পরিচয় ঘটে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। এরপরে তৎকালীন অবিভক্ত ভারত ও অবিভক্ত বাংলার মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনকারী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনের সময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মুসলিম লীগের নির্বাচনি প্রচারের জন্য এক বছর পড়ালেখা স্থগিত রাখেন।
১৯৪৯ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। সঙ্গে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মোহাম্মদ খালেদ যোগ দেন সেই দলে। ১৯৪৯ সালে থেকে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসহ প্রায় সকল আন্দোলনে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।
তবে তাঁর আওয়ামী লীগে আসার পেছনে শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক অবদান ছিল বলে জানান মোহাম্মদ খালেদ। বলেন, ‘কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় শেখ সাহেবের (বঙ্গবন্ধু) সাথে পরিচয় ও হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি যখন এই পার্টির সাথে সম্পৃক্ত, সেই দুর্বলতাও ছিল। শেখ সাহেবের সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অপ্রতিরোধ্য। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের সাংগঠনিক শক্তির সাথে আমরা চট্টগ্রামে সাংগঠনিক শক্তি বিকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম। কাজ করছি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মীরা জনগণের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হচ্ছি। আমরা ঘুরছি পাড়ায় পাড়ায়, মানুষদের ঘরে ঘরে। সম্পর্কের মাধ্যমে মানুষকে আওয়ামী রাজনীতির তাত্ত্বিক দিক বুঝাচ্ছি। মানুষ আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। ছোট ছোট সভা, গ্রুপ মিটিং, আলোচনা সভা করে আওয়ামী লীগের আদর্শ উদ্দেশ্য বুঝাচ্ছি। এমনি করে আমার মতো প্রতিজন নেতা-কর্মী কাজ করেছিলেন।’
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ (বামে)
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধীরে ধীরে অনিবার্য পুরুষে পরিণত হন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি চট্টগ্রাম-৫ (জাতীয় পরিষদ ১৫৮) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯০০। মোহাম্মদ খালেদ পেয়েছেন ৬৩ হাজার ৪৩৩ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটের ৫৭.৪৫ শতাংশ। ওই নির্বাচনে তিনি পরাজিত করেন পাকিস্তান জাতীয় স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে; তিনি মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা।
মুক্তিযুদ্ধ
দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মোহাম্মদ খালেদ (বাম থেকে পঞ্চম)
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য চট্টগ্রামে যে পাঁচ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়, মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এই কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান এবং এম. এ. মান্নান।
জেলা ও নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত হলেও একমাত্র অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন ওই কমিটিতে বঙ্গবন্ধুর মনোনীত সদস্য। প্রথম পর্যায়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এ স্টিয়ারিং কমিটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়। তৎকালীন রেস্ট হাউস, জুপিটার হাউসে কমিটির বৈঠকে মূল সমন্বয়কারী হিসেবেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন মোহাম্মদ খালেদ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এম আর সিদ্দিকীর বাসায় যে বৈঠক করেন, সেখানেও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক খালেদ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ খালেদের কাছে বিপুল ভোটে হেরে যান পাকিস্তানের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে মোহাম্মদ খালেদ দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি মুজিবনগর সরকারের তথ্য দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের উপদেষ্টা ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের শত আর্থিক কষ্টের মাঝেও অন্যদের কষ্টে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের সেনাবহিনী আত্মসমর্পণ করলে পরদিন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ শিরোনাম দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আজাদী’ প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ওই বছরের পয়লা এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। এই স্মারকটি গ্রহণ করে তাঁর পরিবার।
গণপরিষদে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের বৈঠক
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের অধিকাংশই ছিলেন আইনের ছাত্র। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদা ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। তবে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত দুটি বিবেচনায় তাঁকে এই কমিটিতে যুক্ত করেছিলেন। প্রথমত কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় মোহাম্মদ খালেদকে তিনি দেখেছেন। তার প্রতিভা তিনি হয়তো তখনই টের পেয়েছেন। এরপরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার হৃদ্যতা তৈরি হয়। ভাষা আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। এই বাইরে একজন সৎ ও সাহসী সাংবাদিক হিসেবে মোহাম্মদ খালেদের মাটিলগ্নতা, দেশপ্রেম এবং আইনের ছাত্র না হলেও দেশ ও সমাজ সম্পর্তে তাঁর অগাধ জ্ঞান হয়তো বঙ্গবন্ধু বিবেচনায় নিয়েছেন। মোহাম্মদ খালেদ অবশ্য মনে করতেন যে, তিনি এই বিশাল কাজের যোগ্য ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু বলেছেন তাই এই কমিটিতে কাজ করেছেন। এজন্য তিনি গর্ব অনুভব করতেন।
একটি সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ খালেদ জানান, সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারটি পুরোপুরি ড. কামাল হোসেন নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি সংবিধানের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করতেন। পরে সেটির ওপর কমিটির সদস্য আলোচনা করতেন, মতামত দিতেন। বঙ্গবন্ধুও মতামত দিয়েছেন। তারপর তা সংবিধানের ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছে। মোহাম্মদ খালেদ মনে করেন, এই সংবিধান পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং এতে জনমত প্রতিফলিত হয়েছে। বলা চলে প্রশংসা করার মতোই হয়েছিল এই সংবিধান। (প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, সাখাওয়াত হোসেন মজনু-মর্জিনা আখতার, পৃষ্ঠা ৭৫)।
সংবিধান প্রণয়নে মোহাম্মদ খালেদের ভূমিকা কেমন ছিল, সেটি জানাচ্ছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান—যিনি সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭২ সালে যখন অধ্যাপক খালেদ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন, তখন তাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। দেখেছি, অনেক সময়ে যে ধ্যান ধারণা, মত বা পন্থা জনপ্রিয় ছিল, তার বিরুদ্ধেও তিনি সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছেন। তাতে আমিও অস্বস্তিবোধ করেছি, দুঃখিত হয়েছি, তবে সেকথা তাকে বলিনি। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও দেখেছি যে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে নিয়েছেন তিনি। নিজের মত প্রকাশ করে বিবেককে শান্ত করেছেন। তবে জিদ করে সেই মত ধরে বসে থাকেননি। অন্যরা যখন তার মত গ্রহণ করেননি, তখন বৃথা তা নিয়ে আর তর্ক করেননি। নিজে সৎ ও বিশ্বস্ত ছিলেন বলে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ অন্যের সততা ও বিশ্বস্ততায় আস্থা রাখতেন।’ (মোহাম্মদ খালেদ, রাশেদ রউফ, বাংলা একাডেমি/২০১৬, পৃষ্ঠা ৪৫)।
১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর গণপরিষদের বৈঠকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধানের ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘আজ যে সংবিধান আমরা আমাদের দেশের ভাবি নাগরিকদের জন্য রেখে যাচ্ছি, সেই সংবিধানে যদি এমন একটা নীতি না থাকে, যে নীতির দ্বারা আমাদের দেশে যারা ঘুষখোর, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, তাদের যদি উচ্ছেদ করতে না পারি, তাহলে এই সংবিধানের কোনো অর্থ হয় না। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে এ কথা ছিল না। ১৯৬২ সালের সংবিধানেও এই কথা ছিল না। তাই আজকে এই সংবিধানের মাধ্যমে আমরা যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি, সেই সমাজতন্ত্রের নামে আমরা আবার যদি সেই উচ্চ-শ্রেণির দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও সেই ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদেরই আবার দেখতে পাই, তাহলে যারা ভবিষ্যতের নাগরিক, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর, তারা আমাদেরকে বলবে যে, যাঁরা এই সংবিধান প্রণয়ন করে গিয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।’
এ সময় পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে মোহাম্মদ খালেদ বলেন, পরিষদের সামনে বর্তমানে দুটি প্রস্তাব রয়েছে। তাই জনমত যাচাই সম্পর্কীয় প্রস্তাবটির মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত বিলের ওপর আলোচনা চলতে পারে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে তিনি স্পিকারের নির্দেশ কামনা করেন। (ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৯০)।
সংবিধান প্রণয়নের দিনগুলি: মোহাম্মদ খালেদের ডায়রি
হাতে লেখা সংবিধানে মোহাম্মদ খালেদের স্বাক্ষর
সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক ঘটনা নিজের ডায়েরিতে লিখে গেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিলের ডায়েরিতে লিখেছেন: খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির বৈঠক সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হল। ড. কামাল হোসেন উদ্বোধনী বক্তৃতা পড়লেন। কাজের সুবিধার জন্যে তারই তৈরি শাসনতন্ত্রের কপি পেলাম। বৈঠকে বিচারপতি মুনিম, আইন বিশেষজ্ঞ কদলপুরের জনাব এম. এ. কুদ্দুস ছিলেন। ঠিক হল জনসাধারণের মতামত চেয়ে পত্রিকায় দেওয়া হবে। কাল বিকেল ৫টা থেকে পরিচ্ছেদ অনুযায়ী আলোচনা শুরু হবে।
পরদিন ১৮ এপ্রিলের ডায়েরিতে লিখেছেন, বিকেল ৫টা থেকে খসড়া সংবিধান কমিটির বৈঠক শুরু হল। ১৮ (Preamble) প্রস্তাবনা থেকে আলোচনা শুরু হল। ইংরেজিটা নিয়ে প্রথম ব্যারিস্টার বাদল রশীদ পড়লেন। প্রথম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় লাইনে historic struggle এ armed শব্দটি struggle-এর আগে যোগ দেওয়ার জন্য Sk. Abdur Rahman বললেন। Prof. N. Islam Chowdhury ও রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র শব্দ যোগ করতে বললেন। শেষতক armed বা সশস্ত্র শব্দটি struggle এর আগে যোগ করতে সাব্যস্ত হল। ৩য় লাইনে attained-এর উপযুক্ততা সম্পর্কে Khondakar Moshtaque সাহেব প্রশ্ন তুললে সে হলে achieved শব্দ বসাতে সম্মত হল।
সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নিয়ে কমিটির সদস্যরা কী ধরনের বিতর্ক করেছেন এবং মতামত দিয়েছেন, সেটিও জানা যাচ্ছে এদিনের ডায়েরিতে।
মোশতাক সাহেব প্রশ্ন করলেন Democracy বললে Secularism বলার প্রয়োজন আছে কি না? তিনি বললেন Democracy itself, an institution. তাছাড়া Secularism বলে কোনো শব্দও অভিধানে নাই, J, Neheru ও পানি। Democracy মানে Secularism.
এ সময়তাজউদ্দিন সাহেব তাঁর স্বভাববশত (মুদ্রাদোষ?) হাতকে মুষ্টি করে মুখের কাছে নিয়ে (কথা বলার সময় তিনি তাই করেন, মনে হয় তাদের মুঠোটাকে যেন মাইক্রোফোন) হাসছিলেন। লক্ষণীয় দুজনের বিভেদ সব সময় ধরা পড়ে। একে অপরকে সূক্ষ্মভাবে মার দিতে সচেষ্ট।
সিরাজুল হক বললেন, We have heard Islamic Democracy. Basic Democracy. To avoid doubt and by way of abundant clarification and caution the word secularism should be included.
বিতর্কের ঝড় উঠল Democracy Process নিয়ে। এ বিতর্ক দীর্ঘস্থায়ী হল। আমিরুল ইসলাম বললেন: Socialism cannot be achieved by legislation Assemble can only guarantee. We are cheating the people. তাজউদ্দিন আর আমিরুল ইসলাম মনে হল যেন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে Socialism আনতে চান। বিপ্লবের পথকে খোলা রাখতেই তারা আগ্রহ।
নুরুল ইসলাম মঞ্জু বললেন, Socialism এর সুনিশ্চিত কোনো সংজ্ঞা নেই। দেশে দেশে এর পার্থক্য রয়েছে। বিপ্লবকে পরিহার করে গণতান্ত্রিক পন্থায় আমাদের দেশের উপযোগী সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায়। আবু সাঈদ বললেন: সামন্তবাদের বিরুদ্ধে ধনতন্ত্রকে তার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রকে যেমন মুক্তির পথ হিসেবে বিপ্লব হিসেবে গ্রহণ করা হয় তখনই দেখা যায় সমাজতান্ত্রিক দেশও আবার ব্যক্তিগত মালিকানার পথ ধরেছে। তাই সমাজতন্ত্রই চরম লক্ষ্য হতে পারে না। তিনি শব্দ দুটোর পক্ষে মত দেন।
আমিরুল ইসলামের এক মন্তব্যের উত্তরে ড. কামাল হোসেন বললেন: Connotation of democracy is vast. Street corner meeting, co-operation refuse করা সবই democracy Process বাদ দিয়ে ৪র্থ লাইনে freedom শব্দের আগে rule of law বসাতে বললেন।
২৯ এপ্রিলের বৈঠকেও সমাজতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক চলে। এদিন এই ইস্যুতে মোহাম্মদ খালেদও কথা বলেন। তাঁর মতে, যে সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসনতন্ত্রকে সামনে রেখে দাবি তুলেছেন, তাদের ভুললে চলবে না যে, সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে, এর প্রতিষ্ঠাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে তারা প্রথম থেকেই Cadre বা কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করে, ওইসব দেশ, সংবিধান রচনা করেছে। অথচ আমাদের এরূপ মানুষঁ ও কর্মীর অভাব।
৮ অক্টোবর ১৯৭২ সংবিধান কমিটির রিপোর্টে স্বাক্ষর করেন মোহাম্মদ খালেদ। এদিনের ডায়েরিতে লিখেছেন: সন্ধ্যা ৬টায় গণভবন আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা আলাপ হল। ছবি উঠল, টেলিভিশনে দেখান হল। বঙ্গবন্ধু বললেন: I am today the happiest man. মানুষের জীবনে আর কী চাই। দেশ স্বাধীন হল, স্বাধীন দেশের সংবিধানে নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
একটি সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক খালেদ বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করার কথা বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই বলতেন। আমরা পৃথক একটা সংবিধান করব। সে জন্য আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা প্রতিশ্রুতিও ছিল। ড. কামাল হোসেন মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। মার্চে যেদিন ইয়াহিয়া খান সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করে নিয়েছিলেন সেদিন হোটেল পূর্বাণীতে যে বৈঠকটি হয়েছিল, সে বৈঠকের মধ্যেই সংবিধান নিয়ে গোপন একটা আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ে এই নিয়ে আর কথা হয়নি। সবাই তখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু আসলেন। আসার পর বঙ্গবন্ধু তাড়াতাড়ি করে এই দায়িত্ব দিয়ে বললেন এবং বোধ হয় খুব মিনিমাম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর একটা উলেখযোগ্য সংবিধান রচিত হয়- বাংলাদেশের সংবিধান।
তিনি মনে করেন, আমাদের যা চিন্তাভাবনা ছিল তার সমস্ত কিছুই বাহাত্তরের সংবিধানের মধ্যেই রূপ পেয়েছে। জনমত প্রতিফলিত হয়েছে। সেজন্যে আমাদের সংবিধান দেশে-বিদেশে অসম্ভব রকম প্রশংসা অর্জন করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে সংবিধানে যেসব কাটছাঁট হয়েছে, তা নিয়েও আক্ষেপ করেন মোহাম্মদ খালেদ।
বাহাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন
মোহাম্মদ খালেদ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। ওই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৩। মোহাম্মদ খালেদ পেয়েছেন ৩২ হাজার ২৪৩ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটের ৪৭.৭০ শতাংশ।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা করলে তিনি বাকশাল সরকারের চট্টগ্রাম গভর্নর নির্বাচিত হন। তবে গভর্নর হিসেবে প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে পারেননি। নমিনেশনের পর তাঁদের ঢাকায় নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মোহাম্মদ খালেদ বলেন, ‘কথা ছিল ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুকে ডি.লিট পুরস্কার গ্রদানের অনুষ্ঠানে আমরা সবাই একসাথে যাব। এর পর দিন যে যার জেলায় চলে যাব এবং গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করব। কিন্তু আমাদের সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়নি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে ফেললো। সুতরাং আমি প্রশাসনিক দায়িত্ব কিছুই পাইনি। কিন্তু তারপরও বলব যে, আমাকে গভর্নর করা হল, এই কথাটি যখন কোর্ট বিল্ডিং-এ এসে পৌঁছেছিল, তখন তাদের মধ্যে বলাবলি হয়েছিল যে, এই লোকটাকে বশে আনা যাবে না। সুতরাং আমাদের একটু সংযতভাবে চলতে হবে।’
অধ্যাপক খালেদ সারা জীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। রাউজানের ঘরে ঘরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সৃষ্টিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বৃহত্তর চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অনেক। জীবন সায়াহ্নে শারীরিক এবং পত্রিকার দায়িত্ব পালনের কারণে সাংগঠনিক কোনো দায়িত্ব পালন করতে না পারলেও তিনি সব সময় আওয়ামী লীগের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কখনো দল ত্যাগ করেননি। নিজের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেননি।
আগস্ট ট্র্যাজেডি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সেদিন ঢাকায় এমপি হোস্টেলে অবস্থান করছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তিনি জানতেন না যে এত বড় একটা নৃশংস ঘটনা ঘটে গেছে। বলেন ‘হোস্টেলে ছিলাম। খুব আর্লি মর্নিং ৫/৬ টার দিকে একটা টেলিফোন আসে আমার এক বন্ধুর। ফরেন অফিসে চাকরি করতেন। তিনি বললেন যে, আপনার রেডিও আছে? আমি বললাম, এক ব্যান্ডের একটা রেডিও আছে। তিনি বললেন, তাহলে ওটা খোলেন। শুনতে লাগলাম, মেজর ডালিমের ঘোষণা। আমি বললাম, এটা কী কথা? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এটাই কথা। আপনার বাইরের অবস্থা কী? আমি বললাম, বাইরের দরজা-জানালা খুলিনি। তিনি বললেন, খুলে দেখেন তো। আমি দেখলাম, একদল রক্ষীবাহিনী লাইন করে দাঁড়ানো আছে। কয়েকটা ট্যাংক টহল দিচ্ছে। তিনি বললেন, একটু কসাসলি থাকবেন। যদি রক্ষীবাহিনী সারেন্ডার না করে হয়তো গোলাগুলি হতে পারে। গোলাগুলির ক্রস ফায়ারিং-এ ক্ষতিও হতে পারে। আর কিছু জানি না। আপনারা ওখানে থাকেন, দেখা যাক। এরপর তিন দিন সেখানেই থাকতে হয়েছিল, বের হতে পারিনি। আটকা ছিলাম।’
তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বা তারা কি এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে পেরেছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক খালেদ বলেন, ‘তখন সম্পূর্ণ পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে যায়। দল তখন নিষিদ্ধ করে দেয়। আমি একা, প্রথম সারির নেতারা মারা গেলেন। বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কে কি করতে পারতাম, সবাই চুপ করে বসে আছি, কিছুই করার ছিল না।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের ছেলে মোহাম্মদ জহির বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর বাবা গভীর মনোবেদনা নিয়ে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁকে গুটিয়ে রাখতে দেননি। পঁচাত্তর পরবর্তী বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের দুর্দিনে নেতারা ছুটে আসতেন বাবার কাছে। বাবা তাঁদের কখনো হতাশ করেননি। তাঁদের সাহস দিয়েছেন, বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে দলকে সুসংগঠিত করে নেতাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্ক
মোহাম্মদ খালেদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র অবস্থায়। সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে গাঢ় হয়েছে। মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন ইসলামিয়া কলেজে শেখ মুজিবের জুনিয়র। তবে পরবর্তীকালে তাঁরা রাজনৈতিক সহকর্মী। দেশের জন্য একসঙ্গে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরে অনেকে রঙ ও আদর্শ বদলালেও মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন নিজের আদর্শে অবিচল। আমৃত্যু আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন।
মোহাম্মদ খালেদ ১৯৭২ সালের ৭ অক্টোবরের ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘৪ তারিখ চাটগাঁ রওনা হলাম শফিউর রহমানের গাড়িতে। ৭ তারিখ বিমানে ফিরলাম। বিকেলে খসড়া সংবিধান কমিটির সভায় উপস্থিত হলাম। রেস্ট হাউসে যখন ফিরে এলাম তখন মাথার যন্ত্রণায় অস্থির। রাত পৌনে ৯টার দিকে বেয়ারা ছুটে এসে বলল: স্যার, বঙ্গবন্ধু আপনার রুমে আসছেন। এ অপ্রত্যাশিত ঘটনার উত্তেজনায় আমার মাথা ব্যথা ছুটে গেল। শার্টটা গায়ে চড়িয়ে কামরা থেকে বের হতেই শুনলাম তোফায়েল আহমদ (বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সেক্রেটারি) চিৎকার করলেন: খালেদ ভাই কোথায়? বঙ্গবন্ধু এসেছেন। এগিয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন: কি প্রফেসর, খুব তো ঘুমাচ্ছ! বললাম: স্যার ঘুম কোথায়? মাথার যন্ত্রণায় অস্থির। তিনি কামরায় ঢুকলেন, পেছনের দরজা খুলে বাইরে দাঁড়ালেন, তারপর চলে গেলেন। তাঁর সঙ্গে যাচ্ছিলাম, বললেন যাও, রুম খোলা, কাল দেখা হবে। তিনি চলে গেলেন।
মোহাম্মদ খালেদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর ছেলে মোহাম্মদ জহির। ‘বাবার সাথে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতার কারণে আমার শিশুকালে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। একবার বাবার সাথে ঢাকায় গিয়েছিলাম। তখন বাবা আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি আমাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের হাতের স্পর্শ আজও আমি অনুভব করি। তখন ছিল রমজান মাস। বঙ্গবন্ধুর সাথে বাবা কথা বলতে বলতে ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসে। তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথে নিয়ে ইফতার করতে বসেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে ইফতারি করতে বসে খুব অবাক হয়ে গেলাম। আমার ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু দেশের রাজা। গল্পে পড়েছি আর শুনেছি রাজা বাদশাদের খাবারে থাকে মস্ত আয়োজন। বঙ্গবন্ধুর ইফতারের মেন্যুতে তেমন আয়োজন থাকবে বলেই আমার ধারণা ছিল। কিন্তু দেখি তার ইফতারির মেন্যুতে আছে সাধারণ মানুষের মতোই ছোলা, পিঁয়াজু ও মুড়ি। বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম খুব তৃপ্তির সাথে সে সব দিয়ে ইফতার করছেন। এরপর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া ভূ উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে আসেন। উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে রাউজানের সংসদ সদস্য হিসাবে আমার বাবা রাউজান কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। তখন স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। সেই অনুষ্ঠানেও বাবা আমাকে তাঁর সাথে নিয়ে যান। সেদিন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আমি বঙ্গবন্ধুকে ফুল দিয়ে বরণ করেছিলাম। ১৯৮৪ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের রাউজানের বাড়িতে এসেছিলেন। সেদিন তিনি আমাদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। আমরা সবাই তাঁর সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খেয়েছি।’
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
ব্যক্তি হিসেবে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী ব্যক্তিত্ব। শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান লিখেছেন, ‘নিয়মানুবর্তিতা তাঁর জীবনের এক বিশেষ গুণ। যেকোনো সভা-সমিতিতে তিনি সময়মতো হাজির হতেন। তিনি মানুষকে বড় করে দেখতেন। তাঁর কাছে সবাই যেন বড়।’
সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়ার ভাষায়, ‘মানুষের জন্যই তিনি সব সময় নিবেদিত। সেই মানুষ কোন্ সম্প্রদায়ের তা কোনোদিন চিন্তা করেননি। মানুষের বিপদে-আপদে ছুটে গেছেন। রাউজানে বড়ুয়া পাড়ার এক গৃহস্থের ধান খেয়েছে প্রতিবেশী এক মুসলিম গৃহস্থের ছাগল। এ নিয়ে বিবাদ, মারামারি। এমন কি দাঙ্গা বাঁধার উপক্রম। রাউজান জ্ঞানানন্দ বিহারের অধ্যক্ষ প্রিয়ানন্দ মহাথের আমাকে নিয়ে প্রফেসর সাহেবের বাসায় উপস্থিত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ পুলিশ সুপারকে ফোন করে স্পেশাল ফোর্স পাঠিয়ে সেদিন দাঙ্গা রোধের ব্যবস্থা করেন এবং পরবর্তীকালে সালিশের মাধ্যমে তিনি তার মীমাংসা করেন।
অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০)
ইমেরিটস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বয়সে আমার চেয়ে বেশ বড় ছিলেন। কিন্তু তিনি আমাকে সম্বোধন করতেন ‘স্যার’ বলে। অনেক প্রতিবাদ করেছি, কোনো কাজ হয়নি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলেছেন, আপনি স্যারই তো। অথবা কিছু না বলে কেবল হাসির ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন। মুখের ভাবেই বিনয়ের পরাকাষ্ঠা ছিল। এ থেকে মানুষটিকে বোঝা যায়। তিনি স্বভাবতই বিনয়ী ছিলেন। সে-বিনয় নিজের অহংবোধকে একেবারেই ধূলিসাৎ করে দেয়। অথচ জীবনে তিনি যে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, তা সামান্য নয়। সংগ্রাম করে জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন তিনি। পোশাকে-আশাকে সর্বদাই ছিলেন সাধারণের একজন, কম দামি সিগারেটই খেতেন, রিকশায় চড়তে কুণ্ঠিত হতেন না। বয়সে কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠায় যে-ছোটো, তাকেও রীতিমতো সম্মান দেখাতেন। আর এসব কিছুই ছিল তার আন্তরিক, এর মধ্যে কোনো লোকদেখানো ব্যাপার ছিল না।’
আনিসুজ্জামান আরও লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁকে দেখেছি সংকটে অবিচল থাকতে। মানুষের দুঃখে কাতর হয়েছেন, কিন্তু মনোবল হারাননি। কষ্টস্বীকার করেছেন, কিন্তু মুখের হাসিটি মিলিয়ে যায়নি। জাতীয় পরিষদের সদস্য তিনি, কিন্তু জনপ্রতিনিধিরূপে কোনো সুবিধা নেন নি। অমন সুযোগ নেওয়ার ব্যাপারটিই তার কাছে ছিল অভাবনীয়। তার নীতি ছিল, তা থেকে তিনি ভ্রষ্ট হননি। তার আদর্শবোধ ছিল, তাতে তিনি স্থির থেকেছেন।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ইচ্ছে করলেই বিত্তশালী হতে পারতেন। গাড়ি-বাড়ি-সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু সে মোহ তাঁর কখনোই ছিল না। বরং সারাজীবন অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন। আমৃত্যু তিনি ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়েছেন। রিকশায় করে অফিস করেছেন প্রতিদিন। শ্বেত শুভ্র পোশাকে সাদাসিধে জীবনযাপন করেছেন। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। কিন্তু লালন করতেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ। অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ দরদ, সম্মানবোধ। (চেতনার বাতিঘর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৫৮)।
জন্মদিনে মোহাম্মদ খালেদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছেন সাংবাদিক আতাউল হাকিম
অধ্যাপক খালেদ চট্টগ্রামের অনেক সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। নিরলস প্রচেষ্টা ও অবদানের জন্য অনেক সংগঠন তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। চট্টগ্রাম হিলভিউ সোসাইটিতে প্রতিষ্ঠিত নগরীর অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠার স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ অডিটরিয়াম স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট এই মিলনায়তনের উদ্বোধন করা হয়।
পরিবার
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বরেণ্য অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান (সামনে বসা, ডান থেকে তৃতীয়)।
১৯৪৯ সালে আপন মামাতো বোন আমেনা বেগমকে বিয়ে করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। এই দম্পতির দুই মেয়ে ও চার ছেলে। তারা হলেন: ১. আনিকা খানম শিরিন (জন্ম ১৯৫৪), ২. আতিয়া বেগম শামীম (জন্ম ১৯৫৬), ৩. মোহাম্মদ জমির (জন্ম ১৯৫৮), ৪. মোহাম্মদ জহির (জন্ম ১৯৬৭), ৫. মোহাম্মদ মুনির (জন্ম ১৯৭১), ৬. মোহাম্মদ জোবায়ের (জন্ম ১৯৭৩)। সন্তানদের কেউ রাজনীতিতে যুক্ত হননি।
চতুর্থ সন্তান মোহাম্মদ জহির বাবার দেখানো পথে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিক সাপ্তাহিক ‘স্লোগান’ পত্রিকার সম্পাদক। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জীবদ্দশায় ১৯৯১ সালে। প্রথমে এটি ছিল মাসিক। পরে সাপ্তাহিক হয়।
মৃত্যু ও দাফন
মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। তবে অসুস্থতার জন্য মনোবল দুর্বল হয়নি। তবে বড় ছেলে মোহাম্মদ জমিরের দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে তিনি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ২০০৩ সালের ২০ নভেম্বর মোহাম্মদ জমির ইন্তেকাল করেন। সন্তানের মৃত্যুতে তিনি আরও ভেঙে পড়েন। শোক সামলাতে না পেরে তিনিও এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান সন্তানের মৃত্যুর ঠিক এক মাসের মাথায় ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর। পরপর স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন আমেনা বেগম। তিনিও শোকে মুহ্যমান হয়ে ২০০৫ সালের ২৫ জুলাই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সুলতানপুরে গ্রামের বাড়িতে তাঁকে দাফন করা হয়।
মোহাম্মদ খালেদের মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল
তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থ
১. রাশেদ রউফ প্রণীত জীবনী গ্রন্থ ‘মোহাম্মদ খালেদ’, বাংলা একাডেমি/২০১৬।
২. চেতনার বাতিঘর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদক আলীউর রহমান/২০২২।
৩. অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা ২০২২, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব
৪. ছোটদের অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আপন আলো প্রকাশনা/২০১৯।
৫. অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তি সম্মিলিত রাউজানবাসীর স্মরণায়োজনের সংকলন, সম্পাদক শওকত বাঙালি।
৬. অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের চতুর্থ সন্তান মোহাম্মদ জহিরের সাক্ষাৎকার।