হাফেজ হাবীবুর রহমান: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবি ‍তুলেছিলেন বাহাত্তরেই

হাফেজ হাবীবুর রহমান (১৯১৫-১৯৮৫)

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ রয়েছে। বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা যায় কি না, এখন সেই আলোচনাও আছে। কিন্তু ৫০ বছর আগেই এই চিন্তা করেছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির জ্যেষ্ঠতম সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমান। শুধু তাই নয়, সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ বাতিলসম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে তিনি ওই সময়ে যে অবস্থান নেন, সেটিও তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক। উপরন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী গণপরিষদ সদস্যদের দ্বারা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের এখতিয়ার নিয়ে ওই সময়ে বিতর্ক উঠলে হাফেজ হাবীবুর রহমান তারও যুক্তিপূর্ণ জবাব দেন। তাঁর সেই বক্তব্যের আলোকে অন্য আরও একাধিক সদস্য, এমনকি সৈয়দ নজরুল ইসলামও হাফেজ হাবীবুর রহমানের বক্তব্যের উধ্বৃতি দেন।

প্রসঙ্গত, দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে ৩৪ জনকে নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন হাফেজ হাবীবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধুর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। যে কারণে অন্য যেকোনো সদস্যের চেয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করতেন।

হাফেজ হাবীবুর রহমানের জন্ম ১৯১৫ সালে চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার এখলাশপুর ইউনিয়নে বোরোচর গ্রামের সরদার বাড়িতে। যদিও তাঁর জন্ম তারিখটি জানা যায় না। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত উপাত্ত এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যরাও জন্ম তারিখটি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।

হাবীবুর রহমানের বাবা মৌলভী আব্দুল হামিদ। মা আনজুমান নেছা। পিতামহের নাম মেঙ্গুলিয়া সরদার। তাঁর পিতা ও পিতামহ ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের ভূস্বামী ছিলেন। হাবীবুর রহমান শৈশবে পিতৃহারা হন। তাঁর জন্মভিটা পরবর্তীকালে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

শিক্ষা ও রাজনীতি

হাবীবুর রহমানের ছোট ছেলে মইনুর রহমান (জন্ম ১৯৬৪) জানান, তাঁর বাবা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় একটি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে মাকে জানান যে তিনি কোরআনে হাফেজ হতে চান। পুত্রের সেই ইচ্ছায় সায় দিয়ে মা তাঁকে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। সেখানে কোরানে হাফেজ হন এবং ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি মাদ্রাসা থেকে ফাজিল (স্নাতক) পাশ করেন। এরপর আবার সাধারণ শিক্ষা।

কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়। তাঁরা একই হলে (বেকারে হোস্টেল) থাকতেন। হাবীবুর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। সে কারণে ছাত্রজীবন থেকে হাবীবুর রহমানকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সমীহ করতেন শেখ মুজিব। সেই সম্মান অটুট থাকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত। কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে হাফেজ হাবীবুর রহমান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কৃতিত্বে সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ এম.এ পাস করেন।

পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। যোগ দেন জন্মস্থান চাঁদপুর কলেজে। ১৯৫০ থেকে ৫২ সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরের বছর যোগ দেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এখানে শিক্ষকতা করেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫০ সালে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এম.এল.এ) নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের মতো নেতারা হাফেজ হাবীবুর রহমানের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনার জন্য একাধিকবার সভা করেন।

মইনুর রহমান জানান, সম্ভবত ভাষা আন্দোলনের সময় এক মিছিলে বেশ ঝামেলা হয়। ওই সময় তাঁর বাবা হাফেজ হাবীবুর রহমান এবং মওলানা ভাসানী সেখানে ছিলেন। ভাসানী নার্ভাস হয়ে পড়েন এবং শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করলে হাফেজ হাবীবুর রহমান তাঁকে পিঠে করে রাস্তার অন্য পাশে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।

পশ্চিম পাকিস্তানে ফাতিমা জিন্নাহ ও আইয়ুব খানের নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগ মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে করাচিতে নির্বাচনকালীন এক জোটের সভায় অংশ নেন হাফেজ হাবীবুর রহমান। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ফাতিমা জিন্নাহর পেছনে তিনি দাঁড়ানো (বাম থেকে তৃতীয়)।

হাফেজ হাবীবুর রহমান ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মনোনয়নের জন্য করাচিতে সম্মিলিত বিরোধী দলের যে ঐতিহাসিক বৈঠক হয়, সেই বৈঠকে অংশ নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন হাফেজ হাবীবুর রহমান। এই ঐতিহাসিক বৈঠকে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লা খানের সভাপতিত্বে লাখাম হাউজে ওয়ার্কিং কমিটির সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী যে বৈঠক হয়, সেখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, তাজউদ্দিন আহমদসহ অন্যান্যের সঙ্গে হাফেজ হাবীবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।

১৯৬৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়, আগামীকাল সন্ধ্যায় লাখাম হাউজে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী নির্বাচনকল্পে ৫টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শুরু হইতেছে। এই খবরে আরও বলা হয়, লাখাম হাউজে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে হাফেজ হাবীবুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ (সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড, ষাটের দশক প্রথম পর্ব)

এরপরে ১৯৬৬ সালে বিরোধী দলের ঐতিহাসিক কনফারেন্সে যোগ দিতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ ‍মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে প্রতিনিধি দল লাহোরে যায়, সেই দলেও ছিলেন হাফেজ হাবীবুর রহমান।

 

১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন হাফেজ হাবীবুর রহমান এবং বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাকাকালীন তিনি অল্প কিছুদিন দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

৯৬৬ সালের ২০ মার্চ পাকিস্তান অবজারভারে হাফেজ হাবীবুর রহমানের সহ-সভাপতি হওয়ার সংবাদ (সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু, তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক, দ্বিতীয় পর্ব)

বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা প্রণয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন হাফেজ হাবীবুর রহমান। শুধু তাই নয়, আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিসংবলিত আওয়ামী লীগের এই ৬ দফার দলীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দেশবাসীর মধ্যে বিতরণ করার জন্য একটি পুস্তিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। ১৩৪ পৃষ্ঠার এই পুস্তিকা প্রকাশের জন্য যে ৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়, সেই কমিটিতেও তিনি ছিলেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দীন এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান।

পল্টনে জনসভা সম্পর্কিত খবর। মর্নিং নিউজ, ২৫ এপ্রিল ১৯৬৬। (সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু, তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক, দ্বিতীয় পর্ব)

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁর মুক্তি এবং ৬ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ওই বছরের ২৪ এপ্রিল পল্টন ময়দানে যে জনসভা হয়, সেখানে সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আসনটি শূন্য রেখে তার পাশে আরেকটি চেয়ারে বসে সভার কাজ পরিচালনা করেন সহ-সভাপতি হাফেজ হাবীবুর রহমান। সভাপতির চেয়ার খালি রেখে সহ-সভাপতির সভাপতিত্ব করার ঘটনা পাকিস্তানের ইতিহাসে এটিই প্রথম।

উল্লেখ্য, এই জনসভা আহ্বানও করেছিলেন হাফেজ হাবীবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে যখন ঢাকায় আসেন, তখন তেজগাঁও-ফার্মগেট এলাকায় বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁকে অভিবাদন জানায়। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম হাফেজ হাবীবুর রহমান। ওই সভায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি ছয় দফাকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ‘বাঁচা মরার প্রশ্ন’ বলে অভিহিত করেন।

দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর যে আন্তরিকতা এবং তাঁদেরকে আগলে রাখার যে দৃঢ়তা, সেটিরও সাক্ষী হাফেজ হাবীবুর রহমান। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীর রাতে নিজে তাঁর গাড়িতে করে তোফায়েল আহমেদকে হাফেজ হাবীবুর রহমানের গুলশানের বাড়িতে নিয়ে যান আত্মগোপনের জন্য।

৭০-এর নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণপরিষদ

হাফেজ হাবীবুর রহমান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কুমিল্লা-১২ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের (জাতীয় পরিষদের আসন ১৪২) সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে কুমিল্লা-১২ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ৮৬। হাফেজ হাবীবুর রহমান পান ১ লাখ ২৩ হাজার ৮২ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটের ৯৫.৩৯ শতাংশ। (বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল, ঐতিহ্য/২০২৩, পৃষ্ঠা ২৮৮)।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হাবীবুর রহমান আত্মগোপনে চলে যান। পাকিস্তানি আর্মিরা তাঁকে খুঁজতো। একবার পুরোনো ঢাকায় প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় হাবীবুর রহমানের গুলশানের বাড়ির পাশেই পাকিস্তান আর্মির এক মেজর থাকতেন। ওই মেজর প্রায়ই রেডিওতে সংবাদ শোনার জন্য হাফেজ হাবীবুর রহমানের বাড়ি থেকে ট্রানজিস্টার (রেডিও) চেয়ে নিতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগেই জানতে পারেন যে হাফেজ হাবীবুর রহমান আওয়ামী লীগ নেতা এবং একজন এম.এন.এ। এ অবস্থায় হাফেজ হাবীবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের লোকজন পুরো বাড়ির দায়িত্ব একজন বিশ্বস্ত ও সৎ কর্মচারীর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর থেকেই পাকিস্তানি আর্মিরা হাবীবুর রহমানকে খুঁজতো এবং ওই কর্মচারীকে নানারকম ভয়ভীতি দেখিয়ে জানতে চাইতো তিনি কোথায় আছেন। কিছুদিন পরে পাকিস্তানি আর্মিরা বাড়ি থেকে হাফেজ হাবীবুর রহমানের টয়োটা গাড়িটি নিয়ে যায়।

যুদ্ধ চলাকালীন হাফেজ হাবীবুর রহমান একবার গোপনে তাঁর নিজ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে-সহযোগিতা করা এবং খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য যান। তখন রাজাকাররা এটা জানতে পারে এবং হাফেজ হাবীবুর রহমানকে ধরার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতা ও নানা কৌশলে তিনি গ্রাম থেকে সরে যেতে সক্ষম হন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নে যে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন হাবীবুর রহমান। শুধু তাই নয়, ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামসহ কমিটির যে কয়জন সদস্য সংবিধানের খসড়া তৈরি করেন, হাবীবুর রহমান ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এর পেছনে মূলত কারণ ছিল দুটি। ১. তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও শ্রদ্ধাভাজন এবং ২. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে সংবিধান বিষয়ে তাঁর ছিলো বিশেষ জ্ঞান। ষাটের দশকে তিনি পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন, Introduction to Pakistan Constitution, Political science and government, Foreign Constitution-সহ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন।

গণপরিষদে হাফেজ হাবীবুর রহমান

১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান বা সংবিধান বিলের ওপর আলোচনায় বক্তব্য রাখেন হাফেজ হাবীবুর রহমান। তিনি মূলত কমিটির সদস্য সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত এই বিলটি জনমত যাচাইয়ের যে প্রস্তাব করেন, তার বিরোধিতা করে ওই বক্তব্য দেন। যেখানে হাবীবুর রহমান বলেন, ‘জনমত যাচাইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান রচিত হবে, এ সম্বন্ধে কোনো দ্বিমত নাই। একটা দেশের সংবিধান যে সেই দেশের জনমতের উপর গঠিত হবে এবং জনমতের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে, এ সম্বন্ধেও কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা যে দেশে বাস করি, সেই দেশের বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। এখানে শুধু জনমত যাচাইয়ের কথা নয়- দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর এ দেশে শাসনতান্ত্রিক বিভ্রান্তি বিরাজ করছিল, শূন্যতা ছিল, যখন সংবিধান মোটেই ছিল না। এখানে শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে তাদের শোষণ ও প্রভুত্ব কায়েম করবার উদ্দেশ্যে নামমাত্র সংবিধান দিয়েছেন। দেশবাসী প্রথম থেকে, পঁচিশ বৎসর যাবৎ এ সম্বন্ধে সজাগ ছিল। এ দেশের সংবিধান কী রকম হওয়া উচিত, সে সম্বন্ধে দেশের জনগণ দীর্ঘ পঁচিশ বছর যাবৎ শুধু জনমত গঠনই করেনি, তা অর্জনের সংগ্রামও করে এসেছে।’

হাবীবুর রহমান বলেন, ‘শ্রীসেনগুপ্ত সংবিধান শুধু দশ দিনের জন্য যাচাই করতে চেয়েছেন; কিন্তু পঁচিশ বৎসর থেকে এ বিষয়ে জনমত গড়ে উঠেছে। জনগণ তাঁদের সংবিধানের জন্যে কেবল সংগ্রামই করেনি- রক্তও দিয়েছে। পঁচিশ বৎসর ধরে যে অগণতান্ত্রিক সংবিধান ছিল, সেই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত জনমত গড়ে উঠেছে- কেমন গণতন্ত্র হবে, কেমন সমাজ-ব্যবস্থা এখানে হওয়া উচিত। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সম্বন্ধে ঐক্যবদ্ধ জনমত গঠিত হয়েছে, যার ভিত্তিতে আজ সংবিধান গঠিত হতে যাচ্ছে।’

সংবিধান বিলটি জনমত যাচাইয়ের জন্য পাঠানোর প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে হাবীবুর রহমান বলেন, ‘যে সংবিধান আমরা পরিষদে দেখছি, এটা হঠাৎ-রচিত সংবিধান নয়। It has grown like the Constitution of England. এটা পঁচিশ বৎসরের দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে, রচিত হয়েছে। আমরা আজ গণপরিষদে জমায়েত হয়েছি শুধু এটাকে আইনগত রূপ দেবার জন্যে। যেসব মৌলিক নীতি শাসনতন্ত্রে স্থান পেয়েছে, সেগুলোর জন্যে দেশবাসী বহুদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে। এগুলো যাচাই করবার প্রশ্ন এখন বাহুল্য।’ তিনি বলেন, ‘এখন এগুলোকে আইনগত রূপ দেওয়াই আমাদের কাজ। যাচাই যথেষ্ট হয়েছে। শুধু যাচাই কেন, সংগ্রামও করা হয়েছে।’

উল্লেখ্য, বিলটির ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব ইস্যুতে এরপরে গণপরিষদের আরও যেসব সদস্য বক্তৃতা দেন, তাঁদের অনেকেই হাফেজ হাবীবুর রহমানের এই যুক্তি ও বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন।

সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও ১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর যে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন সেখানে বলেন, ‘জনমত কী সেটা জনাব হাবীবুর রহমান বিষদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। গত ২৫ বছরের সংগ্রামের ভিতর দিয়ে যে জনমত প্রতিফলিত হয়েছে, সে জনমতই আজকের জনমত।’(ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ১০০)।

এদিন পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য আসমত আলী শিকদারও তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘হাফেজ হাবীবুর রহমান সাহেবের মতে যে শাসনতন্ত্র দিতে যাচ্ছি, গত পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতার পরে তা দেওয়া হচ্ছে। এই শাসনতন্ত্র দেওয়ার জন্য কতটুকু ত্যাগ ছিল,তা সবাই জানেন।’(গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ১১৫)।

ফ্লোর ক্রসিং ঠেকাতে হাফেজ হাবীবুর রহমানের প্রস্তাব

সংবিধানে স্বাক্ষর করার আগে হাফেজ হাবীবুর রহমান সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদের বিষয়ে নিজের আপত্তি বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংশোধনী ছিল সংবিধানের বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে।

খসড়া সংবিধানে সংসদ সদস্যদের পদ বাতিলের বিষয়ে ৭০ অনুচ্ছেদে যে বিধান করা হয়েছিল, তা নিয়ে শুধু হাফেজ হাবীবুর রহমানই নন, বরং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরও চারজন সদস্য (আছাদুজ্জামান খান, এ কে মুশাররফ হোসেন আখন্দ, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ও সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত) বিরোধিতা করেন।

খসড়া সংবিধানে বিধান করা হয়েছিল, সংসদ সদস্যরা যে দল থেকে নির্বাচিত, সেই দলের বিপক্ষে সংসদে ভোট দিলে এবং দল থেকে বহিষ্কৃত হলে তাদের সদস্যপদ বাতিল হবে।

দলে শৃঙ্খলা রক্ষা তথা ফ্লোর ক্রসিং ঠেকাতে এই বিধান যুক্ত করা হলেও হাফেজ হাবীবুর রহমান এই বিধানটি বাতিলের প্রস্তাব করে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোথাও কোনো রাজনৈতিক দল থেকে বহিষ্কারের কারণে সংসদের সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায় না। সংসদ সদস্য পদের এই ধরনের অবসান কেবল একটি স্বৈরাচারী শাসনে পাওয়া যায়, যেখানে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বিরাজ করে। একজন সংসদ সদস্য ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন, দলের সদস্যদের দ্বারা নন। একবার তিনি নির্বাচিত হলে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য হন এবং তখন তিনি কেবল তাঁর রাজনৈতিক দলের সদস্য থাকেন না। সদস্য পদ বাতিলের এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে দলীয় একনায়কত্ব এবং দলের নেতার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা পায়।’

হাফেজ হাবীবুর রহমানের মতে, কোনো দলের কখনোই জনগণের রায় অর্থাৎ নির্বাচন বাতিল করার অধিকার থাকতে পারে না। দলের নেতারা যেখানে তাঁদের রাজনৈতিক আচরণের জন্য ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ নন, সেখানে একজন সংসদ সদস্য তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।

দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কার্যকরী সদস্যকে নিয়ন্ত্রণমূলক শাস্তি প্রদানের বিধানের প্রয়োজন হয় তাহলে ভোটারদের মাধ্যমে তা করার (রিকল) ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই দল কর্তৃক বহিষ্কারের ভিত্তিতে সদস্যপদ বাতিলের মতো জঘন্য ব্যবস্থা থাকতে পারে না। এ ধরনের ব্যবস্থা বহাল থাকলে দলীয়ভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয়ে সদস্যরা সংসদীয় দলের বৈঠকেও দলের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাবেন না। অধিকন্তু, আমাদের দেশে সংসদীয় নেতা ও দলীয় নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম, রীতি বা প্রথা গড়ে ওঠেনি। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে একজন দলীয় নেতা ও সংসদীয় নেতা আধিপত্য বিস্তারের জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের বা সমর্থকদের দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে অথবা শুধু প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এবং সেখানে দলীয় নেতার প্রিয়ভাজনকে স্থলাভিষিক্ত করতে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হতে পারে। সুতরাং দল কর্তৃক বহিষ্কারের কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের এমন একটি ঘৃণ্য বিধান একটি দলের মধ্যেও অনেক দ্বন্দ্ব ও অচলাবস্থার জন্ম দেবে। দলীয় শৃঙ্খলা এবং নির্বাচনী এলাকা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা সব সময় একই নয় এবং কখনো কখনো তা সাংঘর্ষিক হতে পারে।

এটি নিয়ে গণপরিষদে বিতর্ক হয় এবং গণপরিষদ সদস্য নুরুল হকের প্রস্তাবক্রমে এই অনুচ্ছেদটি সংশোধিত আকার গৃহীত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদের ওপর তিনি যে সংশোধনী আনেন সেটি এরকম: কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না। (আসিফ নজরুল, সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১০৮)। স্পিকার এই সংশোধনীটি ভোটে দিলে কণ্ঠ ভোটে পাস হয়। অর্থাৎ দল থেকে বহিষ্কার করা হলে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধানটি বাদ দেয়া হয়—যার পেছনে হাফেজ হাবীবুর রহমানের ভূমিকা অনেক।

হাফেজ হাবীবুর রহমান চেয়েছিলেন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ

হাফেজ হাবীবুর রহমান উচ্চকক্ষ-সম্বলিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা একটি সর্বজনীন স্বীকৃত ব্যবস্থা উল্লেখ করে সংবিধানের ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদেও সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তিনি বলেন:

১. একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত ষাট সদস্যের সমন্বয়ে একটি উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে।

২. উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষের সমান ক্ষমতা থাকবে, শুধু আর্থিক বিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষের একক অধিকার থাকবে। কোনো বিল নিয়ে দুই কক্ষের মধ্যে কোনো পার্থক্য হলে যৌথ সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

হাফেজ হাবীবুর রহমান এই নোট অব ডিসেন্টে বলেন, উদার গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ফেডারেল বা একক—যা-ই হোক না কেন, বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই এটি গ্রহণ করেছে। উচ্চকক্ষ গ্রহণের জন্য প্রথাগত যুক্তিগুলো বাদেও আমি এখানে লর্ড ব্রাইসের পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করতে চাই, ‘একটি অ্যাসেম্বলির সহজাত প্রবণতা হলো এটি ঘৃণ্য, অত্যাচারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে, সে কারণে সমান ক্ষমতাসম্পন্ন অন্য আরেকটি কক্ষের সহাবস্থান দ্বারা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।’

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে সংসদীয় আধিপত্যের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এখানে দ্বিতীয় কক্ষ থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কোনো অঙ্গকেই অনিয়ন্ত্রিত ও দুর্দমনীয় ক্ষমতা প্রদান করা উচিত নয়।

তাঁর মতে, কিছু বিধানের মাধ্যমে বিচারবিভাগের ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে সংকুচিত করা হয়েছে। তাই সংসদের সর্বব্যাপক ক্ষমতার ওপর কিছু সংশোধনমূলক বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। অধিকন্তু বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে আমাদের সমাজের পুরো কাঠামোকে সমাজতান্ত্রিক আদলে পুনঃনির্মাণ করতে হবে, সেখানে এককক্ষ দ্বারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আধুনিক সংসদীয় ব্যবস্থার সংকট আসলে এই সময়েরই সংকট। তিনি প্রস্তাব করেন, প্রথম কক্ষের মতো দ্বিতীয় কক্ষকেও গণতান্ত্রিকভাবে গঠন করা যেতে পারে। যদিও তাঁর এই সংশোধনীটি গৃহীত হয়নি।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে এটি কার্যকর হয় প্রথম বিজয় দিবসে, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এর আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর হাতে লেখা মূল সংবিধানে স্বাক্ষর করেন হাফেজ হাবীবুর রহমান।

বাহাত্তর-পরবর্তী জীবন

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের নতুন সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে যখন প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে হাফেজ হাবীবুর রহমান অংশ নেননি। বঙ্গবন্ধু তাঁকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি বিনয়ের সাথে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে কাছে রাখার জন্য রাষ্ট্রদূত অথবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হওয়ার জন্য অনুরোধ করলে তিনি পাবলিক সার্ভিস (১ম) কমিশনে যোগদান করেন। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি কমিশনের সদস্য ছিলেন। মইনুর রহমান জানান, বলা চলে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হওয়ার পরেই তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মূলত স্বাস্থ্যগত ও পারিবারিক কারণে তিনি রাজনীতিতে আর সক্রিয় থাকেননি।

আগস্ট ট্র্যাজেডি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হাফেজ হাবীবুর রহমান প্রথম এই খবর জানতে পারেন রেডিওতে। হাবীবুর রহমানের ছেলে মইনুর রহমান তখন ১১ বছরের শিশু। তিনি জানান, তিনি ও তাঁর ভাই স্কুলে যাওয়ার জন্য মূল সড়কে স্কুল বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বাসটি এসে থামার সাথে সাথে একজন লোক ড্রাইভারকে বললেন, ‘ঢাকায় অনেক গন্ডগোল হয়েছে। আপনি ছাত্রদের বাসার কাছাকাছি নামিয়ে স্কুলে ফেরত চলে যান’ এবং ওই লোক মইনুর রহমান ও তাঁর ভাইকেও বাসায় চলে যেতে বলেন। হাবীবুর রহমান মর্নিং ওয়াক শেষ করে বাসায় ফিরে গোসল সেরে রেডিও শোনার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রেডিওতে কোনো অনুষ্ঠান চালু হচ্ছিলো না। মইনুর রহমান ও তাঁর ভাই বাসায় এসে ওই ভদ্রলোকের কথাগুলো বাবাকে জানান। তখন হাবীবুর রহমান চিন্তিত হয়ে রেডিও শোনার চেষ্টা করতে থাকেন। মইনুর রহমান বলেন, ‘রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আব্বার চেহারার মধ্যে একটা ভীষণ শূন্যতা ও হতাশার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি পাগলের মতো বাসার মধ্যে এদিক-ওদিক পায়চারি করতে করতে থাকেন। বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন। তখন বাসার টেলিফোনটিও নষ্ট ছিল।

মইনুর রহমান বলেন, ‘গুলশানে আমাদের বাড়ির পাশেই দুটি বিদেশি পরিবার থাকতো। তাদের বাসায় কাজ করতেন একজন বাঙালি নারী। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটি অনেকেই জেনে গেছেন। ওই গৃহকর্মী তাঁর গৃহকর্তাকে এ কথা বলছিলেন। কিন্তু ঠিক বোঝাতে পারছিলেন না। এ সময় তিনি দেয়ালের ওপার থেকে আমাদেরকে ডাক দিলেন। আব্বা কাছে এসে ওই বিদেশিকে জানালেন যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। এ কথা শুনে ওই বিদেশিদের একজন আব্বাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন নেতৃত্বে কে? আব্বা বললেন, খন্দকার মোশতাক আহমদ। মইনুর রহমান বলছেন, ‘ঈদের চাঁদ দেখলে আমরা যেরকম আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়তাম, ঠিক সেভাবে ওই বিদেশি আরেকজনকে বাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার করে ডাক দিলেন। তাদের যে কী উল্লাস! তারা হৈ হুল্লোড় করতে করতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বিদেশিদের এই ধরনের আচরণ দেখে আব্বা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ হয়ে যান।’ মইনুর রহমান বলেন, ‘তখন বুঝতে পারিনি তারা কেন এভাবে উল্লাস করলেন। এখন তা ধারণা করতে পারি।’ তাঁর ধারণা, ওই দুজন হয়তো কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর হাফেজ হাবীবুর রহমান মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ধীরে ধীরে যাবতীয় কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।

বিশ্বাসী প্রগতিশীল

কোরআনে হাফেজ এবং ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও হাবীবুর রহমান ছিলেন প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামির আমির গোলাম আযম দেশে ফিরে আসার পরে হাবীবুর রহমানকে এই দলে যুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা হয়। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই স্বাধীনতাবিরোধীদের দলে যুক্ত হতে রাজি হননি। এমনকি তাঁকে জামায়াতের একটি জনসভায় ইসলামিক আলোচনা করার জন্য অনুরোধ করা হলেও তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। জিয়াউর রহমানও তাঁকে মন্ত্রিসভা ও দলে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানালে সেই প্রস্তাবও তিনি গ্রহণ করেননি।

প্রসঙ্গত, লেখাপড়া শেষ করে কর্মজীবনের প্রথম দিকে হাফেজ হাবীবুর রহমান কিছু ইসলামিক আলোচনা (ওয়াজ) করেছেন। ওই সময় ঢাকায় আইডিয়াল পাবলিকেশন্সের কাছাকাছি একটি মসজিদে স্থানীয়দের অনুরোধে তিনি মাঝেমধ্যে ইমামতি করেছেন।

সাংবাদিক হাবীবুর রহমান

হাফেজ হাবীবুর রহমান ছয় দফা নিয়ে পুরো পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনমত তৈরির কাজ করেন এবং ছয় দফা প্রচারের জন্য ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত করেন। পরবর্তীতে ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকাটি তিনি আর কখনো চালু করেননি।

এরপর তিনি ‘সাপ্তাহিক বাংলার বাণী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় ‘বাংলার বাণী’ সাপ্তাহিক আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১১ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পত্রিকাটি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হয়।

শেখ ফজলুল হক মণির ভাষায়: ‘ঢাকাস্থ বাংলার বাণীর দপ্তর থেকে পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যদের আঘাতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে যখন আমরা উৎখাত হলাম তারপর আর কলম ধরিনি। তবু সহকর্মীদের সহযোগিতায় বাংলার বাণী মুজিব নগর থেকে প্রকাশিত হয়েছে।’ (দূরবীণে দূরদর্শী, আগামী প্রকাশনী/২০২০, পৃষ্ঠা ১১)।

বাংলা একাডেমির সাবেক লাইব্রেরিয়ান শামসুল হক তাঁর ‘বাংলা সাময়িকপত্র’ নামে গবেষণা গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন: ‘মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত যে সংখ্যাটি দেখেছি, সেটির প্রকাশকাল ১৫ ভাদ্র বুধবার ১৩৭৮ (১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)। এ সময় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আমির হোসেন। পত্রিকাটি মুজিবনগর থেকে সম্পাদক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।’ গবেষক শামসুল হক যে সংখ্যাটি দেখেছেন সেটির পৃষ্ঠা ছিল ৮ এবং দাম ছিল ৩০ পয়সা। ওই সংখ্যায় জানানো হয়, আগামী সংখ্যা হতে সাপ্তাহিক বাংলার বাণী প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি পত্রিকাটিকে দৈনিকে রূপান্তরিত করতে চাইলে হাফেজ হাবীবুর রহমান তাঁকে পত্রিকাটি বুঝিয়ে দেন। এরপর থেকে দৈনিক বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসেবে থাকেন শেখ ফজলুল হক মণি।

দৈনিক হিসেবে এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ৮ ফাল্গুন সোমবার ১৩৭৮ (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) শহীদ দিবসে। সম্পাদক হন শেখ ফজলুল হক মণি। ওই সংখ্যায় মুকুল রহমান রচিত ‘নবযাত্রা পথে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের নির্ভিক মুখপত্র বাংলার বাণী প্রথম থেকেই ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচত্রের রোষানলে পতিত হয় এবং ২৬ মার্চ ১৯৭১ এই ঔপনিবেশিক পশুশক্তি সকল হিংস্রতা নিয়ে বাংলার বাণী কার্যালয়ের ওপর হামলা চালায়। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গোলায় বিক্ষত বাংলার বাণী কার্যালয় থাকে হানাদার বাহিনীর গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তারা সকল কাগজপত্র, নথি এবং ব্যবহারিক দ্রব্যাদি কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এই সকল কাগজপত্র সূত্র ধরেই বাংলার বাণীর জনৈক কর্মীকে বর্বরবাহিনী তার গ্রামের বাড়িতে হত্যা করে এবং প্রেস ম্যানেজারকে গ্রেপ্তার করে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়।

মুজিবনগর থেকে বাংলার বাণী ‘শেখ মুজিবের পথই আমাদের পথ’ এই স্লোগান দিয়ে মুক্তি সংগ্রামের মুখপত্র হিসেবে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে এবং অধিকৃত বাংলার জনমনে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনুভূতি জাগরুক রাখার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।

এই নিবন্ধে বাংলার বাণীর যে ইতিহাস লেখা হয়েছে তা এরকম: ‘স্বাধীনতার সূর্যস্নাত স্বদেশে বাংলার বাণী দৈনিক আকারে প্রথম আত্মপ্রকাশ করল। স্বাধীনতার প্রথম লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলার বাণী ১৯৭০ সালের ১১ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর আশির্বাদপুষ্ট হয়ে জনাব হাফেজ হাবীবুর রহমানের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক আকারে আত্মপ্রকাশ করে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো, মুক্ত স্বদেশে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তথা মুজিববাদ প্রতিষ্ঠায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করাই বাংলার বাণীর চূড়ান্ত লক্ষ্য।’

মুকুল রহমানের ভাষায়: ‘মুক্ত স্বদেশে বাংলার বাণী নব উদ্যম ও চেতনায় সঞ্জীবিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। মূল লক্ষ্য আমাদের সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক সুষমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লুণ্ঠিত-লাঞ্ছিত বাংলার বুকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের, সাধের সোনার বাংলা গড়ে তোলায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।’

পত্রিকাটি এ সময় ১১৭/এ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা থেকে সম্পাদক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। শহীদ সংখ্যার পৃষ্ঠা ৩৬ এবং দাম ছিল ৬০ পয়সা। (শামসুল হক, বাংলা সাময়িকপত্র প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩)।

বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হাফেজ হাবীবুর রহমানের ছেলে মইনুর রহমান জানান, তিনি তাঁর বাবার কাছে শুনেছেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কয়েক বছর পরে একদিন শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ভাই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম তাঁর বাবাকে (হাবীবুর রহমান) ফোন করে ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকাটি নতুন করে চালু করার বিষয়ে পরামর্শ করেন। তাঁর বাবা শেখ সেলিমকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পত্রিকাটি পুরনায় চালুর করার পরামর্শ দেন।

লেখক ও প্রকাশক হাবীবুর রহমান

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সাথে সাথে বই লেখার কাজে হাত দেন হাফেজ হাবীবুর রহমান। তিনি লিখতেন ‘এইচ রহমান’ নামে। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, উচ্চতর পৌরনীতি, উচ্চতর অর্থনীতি, ইতিহাসসহ পূর্ব পাকিস্তানের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু পাঠ্যবই রচনা করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ওই বইগুলো ইংরেজিতে রচনা করেন—যা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।

হাবীবুর রহমানের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই: Political science and government, Beginners Economics, Pakistan Economics, Beginners Civics, Introduction to Pakistan Constitution, Foreign Constitution, History of Indo-Pakistan, Elements of Sociology, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিচিতি, উচ্চতর অর্থনীতি, উচ্চতর পৌরনীতি, পাক ভারতের ইতিহাস, পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন।

হাফেজ হাবীবুর রহমান পঞ্চাশের দশকের দিকে পুরানো ঢাকার বাংলাবাজারে ‘আইডিয়াল পাবলিকেশন্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। দ্রুতই এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি পূর্ব পাকিস্তানে পরিচিত হয়ে ওঠে। এরপর তাঁর বইগুলো এই প্রকাশনী থেকেই বের হতে থাকে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে তিনি তাঁর এক নিকটাত্মীয়র কাছে প্রতিষ্ঠানটি হস্তান্তর করেন। পরে তারা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘আইডিয়াল লাইব্রেরি’।

মইনুর রহমান জানান, তাঁর বাবা বাসায় বেশির ভাগ সময় তাঁর বইয়ের প্রুফ দেখার কাজে ব্যস্ত থাকতেন।

হাফেজ হাবীবুর রহমানের ব্যক্তিজীবন

হাফেজ হাবীবুর রহমান ছিলেন সৎ, নীতিবান ও আদর্শবান মানুষ। তিনি তার কথার খেলাপ করতেন না। নীতির সাথে কখনো আপোস করেননি। তাঁর গুলশানের ১১৫ নং বাড়িটি ১৯৭৩ সালে বায়না করার পরেই কিছুদিনের মধ্যে বাড়ির মূল্য ক্রমাগতভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকলে অনেকেই তাঁকে বলেছিলেন যে, তিনি চাইলে বায়নাটি বাতিল করতে পারেন। তাতে আরও বেশি দামে বাড়িটা বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু তিনি বায়না বাতিল করেননি। কারণ ক্রেতাকে তিনি কথা দিয়েছেন। অর্থ বা ক্ষমতার মোহ তাঁকে স্পর্শ করেনি।

হাফেজ হাবীবুর রহমান মানুষকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। অনেকেই ঢাকায় পড়তে এসে থাকা ও খাওয়ার সংকটে পড়লে তিনি নিজের বাড়িতে তাঁদের আশ্রয় দিতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

হাফেজ হাবীবুর রহমানের স্ত্রী ও সন্তান

হাফেজ হাবীবুর রহমানের স্ত্রী জোহুরা খাতুন (গৃহিণী), মৃত্যু: ১৯৯৫। বড় মেয়ে রাশিদা আক্তার (গৃহিণী), স্বামী মুদাচ্ছের আহম্মেদ (সিভিল ইঞ্জিনিয়ার)। ছোট মেয়ে রুখসানা আক্তার (গৃহিণী), স্বামী মো. শামীম হাসান (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার)। বড় ছেলে মশিউর রহমান (ব্যবসায়ী), মৃত্যু: ২০২২, কলকাতা। ছোট ছেলে মইনুর রহমান (ব্যবসায়ী)। হাবীবুর রহমানের চার সন্তানের কেউই রাজনীতিতে জড়িত হননি।

মইনুর রহমান জানান, হাফেজ হাবীবুর রহমান চাঁদপুরের মতলব থানায় আওয়ামী লীগকে প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে তাঁরই আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীরা সেখানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ধরে রেখেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল তাঁর নিকটাত্মীয়। তাঁরা উভয়ই সম্পর্কে হাফেজ হাবীবুর রহমানের মামাতো ভাই।

অসুস্থতা, মৃত্যু ও দাফন

১৯৮৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে হাফেজ হাবীবুর রহমানের মৃত্যু হয়। ওই হাসপাতালে তিনি প্রায় এক মাস ভর্তি ছিলেন। মইনুর রহমান জানান, তাঁর বাবা খুবই স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিকে ভূগলেও শারীরিকভাবে ফিট ছিলেন। প্রতিদিন দুই বেলা শরীর চর্চা করতেন। ভাত খেতেন খুবই কম। কিন্তু এর মধ্যে একটি ছোট দুর্ঘটনায় আহত হলে ডাক্তার তাঁকে মাত্রাতিরিক্ত পেইনকিলার ট্যাবলেট দেন। ধারণা করা হয়, এ কারণে তাঁর কিডনি অকেজো হয়ে যায়। ওই সময় দেশে কিডনির ডায়ালাইসিস খুব আধুনিক ছিল না। হাবীবুর রহমানকে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

তথ্যসূত্র: আমীন আল রশীদ, সংবিধান প্রণেতাগণ, শিলালিপি/২০২৩।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top