আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী (জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯)
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট সম্পর্কে সাধারণভাবে একমত পোষণ করলেও এমপিদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল সম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলের ১, ২ এবং ৩ নং দফা সম্পর্কে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিপত্র দেন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী।
৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে এরকম অনুচ্ছেদ যুক্ত করা একরকম অনিবার্য ব্যাপার। এটি আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কুফল থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। এর ফলে দলকে ভেঙে সংসদে আরেকটি দল গঠন ও ব্যক্তিগত বিবেচনায় দলীয় আনুগত্য পরিবর্তন করা রোধ হবে এবং এটি এই দেশে সঠিক সংসদীয় অনুশীলন ও প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। তবে এ দেশে সংসদীয় রাজনীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন জনমত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড গাইড করবে এবং কোনো সদস্য জনমতকে উপেক্ষা করে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না, তখন এ ধরনের বিধানের কোনো প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা এ ধরনের বিধান ছাড়াই খুব ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু আমরা এ দেশে প্রথমবারের মতো সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে যাচ্ছি, সেহেতু আমাদের উচিত প্রাথমিক পর্যায়ে এর ওপর সম্ভাব্য যেকোনো আক্রমণের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। তাই অন্তত ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সংসদ সদস্যদের ওপর এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। কিন্তু এই বিধিনিষেধটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না কি একটি সাধারণ আইন দ্বারা আরোপিত হবে, তা বিবেচনার বিষয়। আমার মতে, বিদ্যমান রাজনৈতিক ধ্যানধারণার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি সাধারণ আইন দ্বারা আরোপ করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি আইন বর্তমানে ভারতীয় লোকসভায় বিবেচনাধীন রয়েছে। আমি মনে করি, সাংবিধানিক বিধান ছাড়াই একই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে ভালো হবে।’
তবে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি সংবিধানে যুক্ত করতেই হয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের পরামর্শ দেন মুন্তাকীম চৌধুরী। এজন্য তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হলেই কারো সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধান নিয়ে আরও আলোচনার প্রস্তাব দেন। কেননা তার মতে, এই বিধানটি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির জন্ম দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি এমনও হতে পারে যে একটি রাজনৈতিক দল দুই বা ততোধিক ভাগে বিভক্ত এবং দলের সম্পাদক যদি সংখ্যালঘু অংশের অন্তর্ভুক্ত হন, তবে তিনি সম্পাদক হিসেবে তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যার ফলস্বরূপ যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অন্তর্ভুক্ত, তাদের সংসদের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে।
এর পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক দলের সম্পাদক তার প্রভাব বলয়ের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে দলের অধিকতর প্রভাবশালী সদস্যদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করতে পারেন। এর একটি চরম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে একটি রাজনৈতিক দলের সম্পাদক যদি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হন, তবে তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যাতে সংসদে দলীয় প্রধানেরও সদস্য পদ বাতিল হতে পারে এবং ফলে তিনিই কার্যত সংসদীয় দলের নেতায় পরিণত হবেন।
এরকম বাস্তবতায় ৭০ অনুচ্ছেদের এই বিধানটি বাতিল করে তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। সেটি হলো, কোনো সংসদ সদস্য যে দলের টিকিটে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদি ভোট দেন, তবে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে এবং এই ক্ষেত্রে দলের আস্থা রয়েছে এমন সংসদীয় দলের নেতা কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে স্পিকারকে কাজ করতে হবে। তিনি মনে করেন, ৭০ অনুচ্ছেদের মতো একটি বিধান গ্রহণ করতে হলে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্লিখন জরুরি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটির যে চারজন সদস্য এখনও জীবিত, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। জীবিত বাকি তিন সদস্য হলেন ড. কামাল হোসেন (কমিটির সভাপতি), ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। মুন্তাকীম চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। শুধু বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখাই নয়, বরং তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশ-জাপান বন্ধুত্ব তথা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থপতি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে যেসব উন্নত দেশ বাংলাদেশের সূচনালগ্নেই স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং পাশে দাঁড়িয়েছিল, জাপান তার একটি। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় জাপান। এর এক মাসের মধ্যে ঢাকায় শুরু হয় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে জাপান হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশকে যত দেশ উন্নয়ন সাহায্য দেয়, জাপান সেই তালিকায় সবার উপরে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৭২ সালের ১৩-১৪ মার্চ জাপানের সংসদ সদস্য তাকাশি হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। দেশে ফিরে হায়াকাওয়া বাংলাদেশকে অনতিবিলম্বে ১০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি অনুদান এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের হিস্যা আদায়ে জাপানের মধ্যস্থতা করার বিষয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব রাখেন। প্রধানমন্ত্রী সাতোর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। (ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বণিকবার্তা, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।
এর পরের বছর ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাপানে শীর্ষ পর্যায়ের প্রথম সফরে বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। ওই বছরের ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় টোকিওতে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের পটভূমি তুলে ধরেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সহায়তা ও সমর্থনের জন্য জাপান সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
অবকাঠামো ছাড়াও বাংলাদেশের যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য খাতে জাপানের সহায়তা অবিস্মরণীয়। আর বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের এই বন্ধুত্বের নেপথ্য নায়ক ব্যারিস্টার আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী; জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত।
বঙ্গবন্ধু এবং জাপানের সংসদ সদস্য তাকাশি হায়াকাওয়ার সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরী
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি
যৌবনে বড় মেয়ে টিউলিপ চৌধুরীর সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরী
সিলেটের কানিহাটি জমিদার পরিবারের সন্তান মুন্তাকীম চৌধুরীর পুরো নাম আবু তাহের আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯।
মুন্তাকীম চৌধুরীর বাবা খান বাহাদুর তজম্মুল আলি চৌধুরী ছিলেন সিলেটের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম দিকের গ্র্যাজুয়েটদের অন্যতম। ১৯০০ সালের দিকে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসি ভাষায় অনার্সসহ বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের অধীনে আসাম সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি ১৯১৯ সালে আসামের বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি শহরের এসডিও ছিলেন। সারা জীবন তিনি ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি গোয়ালপাড়া জেলার ডেপুটি কমিশনার হিসেবে অবসরে যান।
মুন্তাকীম চৌধুরী আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই.এ পাস করেন। তাঁর আত্মীয় জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার, প্রখ্যাত কূটনীতিক হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে একই রুমে থাকতেন। তিনি শান্তিনিকেতন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে লন্ডনের লিংকনস ইনে পড়াশোনা করেন। লিংকনস ইনেও তাঁর সহপাঠি ছিলেন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী।
পেশাগত জীবন
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৫৫ সালে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করার পর ১৯৫৬ সালে আইন পেশায় যোগ দেন। তিনি ঢাকা সিটি ল’ কলেজেরও খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৮৭-৯০ সাল পর্যন্ত তিনি আইনবিষয়ক জার্নাল ডিএলআর-এর প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও পরে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
ভাসানী ন্যাপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিরোধী দলের চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নেন।
১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর অনেকবার সাক্ষাৎ হয়। আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর জামাতা প্রখ্যাত জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী জানান, ১৯৬২ সালে মুন্তাকীম চৌধুরী যখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য, তখন বঙ্গবন্ধুকে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হলে মুন্তাকীম চৌধুরীকে যেন আওয়ামী লীগে যুক্ত করা হয়।
সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের নেতাদের সংবর্ধনার সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ নভেম্বর ১৯৬২
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ১৯৬২ সালে ১০ই নভেম্বর। এদিন ট্রেনযোগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের নেতারা সিলেটে যান। সিলেট রেলস্টেশনে তাঁদের বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। পরদিন ১১ই নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়, ট্রেনটি স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই সিলেটের রাজনীতিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সুধী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার মানুষ অধীর আগ্রহে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেনটি সিলেট স্টেশনে পৌঁছালে উপস্থিত জনতার ‘গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কায়েম করো, শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ, দমন নীতি চলবে না’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। এই সফরে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আবু হোসেন সরকার, পীর মোহসেন উদ্দীন, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, হোসেন মনসুর প্রমুখ। খবরে বলা হয়, একই ট্রেনে জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীও সিলেটে আসেন এবং সংবর্ধনাকারীদের সঙ্গে যোগ দেন।
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর কাছ থেকে ড. আবেদ চৌধুরী শুনেছেন, ট্রেনের কামরায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর অনেক কথাবার্তা হয়। বিশেষ করে তাঁর আওয়ামী লীগের যোগদানের বিষয়ে।
এরপর ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের একটি খবরের শিরোনাম: ‘অদ্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সিলেট যাত্রা।’ খবরে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ৫ দিনব্যাপী সিলেট জেলা সফরের জন্য আজ রাতে সিলেট যাত্রা করবেন। তারা রবিবার সুনামগঞ্জে, সোমবার সিলেটে, মঙ্গলবার বিয়ানী বাজারে, বুধবার হবিগঞ্জে এবং বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারে জনসভায় বক্তৃতা করবেন।
এর দুদিন পরে, অর্থাৎ ৩১ আগস্ট প্রকাশিত খবরের শিরোনাম: ‘মোসাহেবদের দ্বারা পুর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব নহে।’ অর্থাৎ ওইদিন সুনামগঞ্জ টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তৃতা দেন, সেখান থেকে একটি বাক্য উধ্বৃত করে শিরোনামটি করা হয়। খবরে বলা হয়, এই জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরীও বক্তব্য দেন।
তার মানে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সালের আগস্টের মধ্যে কোনো এক সময় আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আবেদ চৌধুরী জানান, সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে একদিন রাতে তাজউদ্দিন আহমদকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে মুন্তাকীম চৌধুরীর বাসভবনে আসেন এবং তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদানের পরামর্শ দেন।
মুন্তাকীম চৌধুরী সম্ভবত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। এরপর থেকে তিনি জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে পরিচিত হন। ইত্তেফাকের সংবাদেও তাঁকে ‘জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৬৪ সালের আগস্টে সিলেটে আওয়ামী লীগের জনসভা নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদ
প্রসঙ্গত, ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন মুন্তাকীম চৌধুরী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন, তখন তাঁকে এই কাজে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেন ড. আবেদ চৌধুরীর বড় ভাই আব্দুল মুক্তাদির জুবেদ চৌধুরী।
মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট-৫ আসন থেকে জাতীয় পরিষদ (জাতীয় পরিষদ ১২৪) সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের পরে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটিতে তাঁকে যুক্ত করা হয় মূলত আইন ও সংবিধান বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য। পরবর্তীতে দেখা যাবে যে খসড়া সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়েছে, সেখানে জনাব চৌধুরী অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। এমনকি কমিটির যে ছয় জন সদস্য সংবিধানের ওপর নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
গণপরিষদে ভূমিকা
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম বৈঠকে আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী গণপরিষদ পরিচালনার জন্য কার্যপ্রণালিবিধির ১৫ নম্বর ধারার ২ উপধারার বিষয়ে বৈধতার প্রশ্ন তোলেন। অর্থাৎ গণপরিষদ পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতি যে অস্থায়ী কার্যপ্রণালিবিধি দিয়েছিলেন, সেটি যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে এই পরিষদের এখতিয়ার ক্ষুণ্ন হয় কি না, তিনি সেই প্রশ্ন তোলেন। কেননা ১৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, কার্যপ্রণালিবিধি তৈরি করবে পরিষদ। এ নিয়ে আরও একাধিক সদস্য প্রশ্ন তুললে তখন বঙ্গবন্ধু বক্তব্য দেন এবং বলেন যে, এই গণপরিষদে বসার জন্য একটি কার্যপ্রণালিবিধি দরকার। না হলে তারা কীসের ভিত্তিতে বসবেন? সেজন্যই রাষ্ট্রপতি একটি অস্থায়ী বিধি দিয়েছেন। অর্থাৎ এটি আপৎকালীন বিধি। এরপর আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের প্রস্তাব্তি বিধিটি পাসের জন্য পরিষদের সভাপতি ভোটে দিলে সেটি পাস হয়। (ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২১)।
গণপরিষদের দ্বিতীয় বৈঠকে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল কার্যপ্রণালিবিধির ৪৮ ধারা নিয়ে বিতর্ক উঠলে সে বিষয়েও বক্তব্য দেন মুন্তাকীম চৌধুরী।
পরিষদের দ্বাদশ বৈঠকে ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর সংবিধান বিলের ওপর আলোচনা করেন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। যেখানে তিনি বলেন, ‘এই সংবিধান বিবেচনা করতে গিয়ে সর্বপ্রথম আমাদের দেখতে হয় যে, এই সংবিধান-বিলে এ দেশের মেহনতী মানুষের, এ দেশের কৃষক- শ্রমিকের, এ দেশের নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে কি না। তা দেখতে গিয়ে সর্বপ্রথম বিবেচনা করতে হয় যে, আমাদের জনগণকে শোষণমুক্ত করার, আমাদের জনসাধারণের শোষণ-মুক্তির যে দাবি, সেটা এই সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছে কি না।’
মেহনতী মানুষের, কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি এবং শোষণমুক্তির ব্যবস্থা এই সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সংবিধানে এ দেশের জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ যারা সেই কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষ- তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই সংবিধানের ১৫ নম্বর ও ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের মাধ্যমে তাঁদের সর্ববিধ উন্নয়নের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
সংবিধানে ২২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার-বিভাগকে পৃথক করার কথা তুলে ধরে আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ২৩৫ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এটা করতে চেয়েছে; কিন্তু সুনির্দিষ্টভাব তা করতে পারেনি। শুধু ভবিষ্যতের জন্য একটা ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু আমরা আজকে এটাকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করে দিয়েছি।’
এই সংবিধান জনসাধারণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেকোনো দেশে যেকোনো অধিকারই দেওয়া হোক না কেন, সে অধিকার অবাধভাবে দেওয়া হয় না। রাইটের সঙ্গে অবলিগেশনের প্রশ্ন রয়েছে। সেটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইনের মাধ্যমে এটা আনা হয়। তা না হলে কনফ্লিক্ট সৃষ্টি হতে পারে। আমরা শুধু আইনের মাধ্যমে এর ব্যবস্থা করেছি। সেই আইন যুক্তিযুক্ত কি না, জনসাধারণের নৈতিক স্বার্থে সে সব করা হয়েছে কি না, সেটা দেখবার এখতিয়ার আদালতের আছে। অবাধ স্বাধীনতা নাই। সুতরাং, আমরা এখানে এ ব্যবস্থা করেছি।’
বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে যা বলেছিলেন
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট সম্পর্কে সাধারণভাবে একমত পোষণ করলেও এমপিদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল সম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলের ১, ২ এবং ৩ নং দফা সম্পর্কে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিপত্র দেন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী।
৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে এরকম অনুচ্ছেদ যুক্ত করা একরকম অনিবার্য ব্যাপার। এটি আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কুফল থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। এর ফলে দলকে ভেঙে সংসদে আরেকটি দল গঠন ও ব্যক্তিগত বিবেচনায় দলীয় আনুগত্য পরিবর্তন করা রোধ হবে এবং এটি এই দেশে সঠিক সংসদীয় অনুশীলন ও প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। তবে এ দেশে সংসদীয় রাজনীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন জনমত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড গাইড করবে এবং কোনো সদস্য জনমতকে উপেক্ষা করে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না, তখন এ ধরনের বিধানের কোনো প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা এ ধরনের বিধান ছাড়াই খুব ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু আমরা এ দেশে প্রথমবারের মতো সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে যাচ্ছি, সেহেতু আমাদের উচিত প্রাথমিক পর্যায়ে এর ওপর সম্ভাব্য যেকোনো আক্রমণের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। তাই অন্তত ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সংসদ সদস্যদের ওপর এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। কিন্তু এই বিধিনিষেধটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না কি একটি সাধারণ আইন দ্বারা আরোপিত হবে, তা বিবেচনার বিষয়। আমার মতে, বিদ্যমান রাজনৈতিক ধ্যানধারণার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি সাধারণ আইন দ্বারা আরোপ করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি আইন বর্তমানে ভারতীয় লোকসভায় বিবেচনাধীন রয়েছে। আমি মনে করি, সাংবিধানিক বিধান ছাড়াই একই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে ভালো হবে।’
তবে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি সংবিধানে যুক্ত করতেই হয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের পরামর্শ দেন মুন্তাকীম চৌধুরী। এজন্য তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হলেই কারো সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধান নিয়ে আরও আলোচনার প্রস্তাব দেন। কেননা তার মতে, এই বিধানটি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির জন্ম দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি এমনও হতে পারে যে একটি রাজনৈতিক দল দুই বা ততোধিক ভাগে বিভক্ত এবং দলের সম্পাদক যদি সংখ্যালঘু অংশের অন্তর্ভুক্ত হন, তবে তিনি সম্পাদক হিসেবে তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যার ফলস্বরূপ যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অন্তর্ভুক্ত, তাদের সংসদের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে।
এর পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক দলের সম্পাদক তার প্রভাব বলয়ের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে দলের অধিকতর প্রভাবশালী সদস্যদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করতে পারেন। এর একটি চরম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে একটি রাজনৈতিক দলের সম্পাদক যদি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হন, তবে তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যাতে সংসদে দলীয় প্রধানেরও সদস্য পদ বাতিল হতে পারে এবং ফলে তিনিই কার্যত সংসদীয় দলের নেতায় পরিণত হবেন।
এরকম বাস্তবতায় ৭০ অনুচ্ছেদের এই বিধানটি বাতিল করে তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। সেটি হলো, কোনো সংসদ সদস্য যে দলের টিকিটে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদি ভোট দেন, তবে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে এবং এই ক্ষেত্রে দলের আস্থা রয়েছে এমন সংসদীয় দলের নেতা কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে স্পিকারকে কাজ করতে হবে। তিনি মনে করেন, ৭০ অনুচ্ছেদের মতো একটি বিধান গ্রহণ করতে হলে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্লিখন জরুরি।
সংবিধান কার্যকরের এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তাব
সংবিধানের চতুর্থ তফসিল (অনুচ্ছেদ ১৫৩ ক) ক্রান্তিকালীন বিধানাবলির অধীনে দফা ১, ১ক এবং ১খ সম্পর্কে মুন্তাকীম চৌধুরী যে পরামর্শ দেন তা হলো: সংবিধান প্রবর্তনের পরপরই নির্বাচন হতে হবে এবং সম্ভব হলে প্রথম নির্বাচনের তারিখ সংবিধানেই উল্লেখ থাকতে হবে। নির্বাচন সাপেক্ষে অন্তর্বর্তী সময়ে দেশ পরিচালনার জন্য সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান থাকা উচিত বলে তিনি মত দেন।
তার প্রস্তাব, খসড়া সংবিধানে বিধান করা হয়েছে যে সাধারণ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের শাসন সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যেভাবে ছিল সেভাবেই চলবে। এই ধারার অর্থ খুব স্পষ্ট নয় এবং এটি নিশ্চিতভাবেই বিভ্রান্তির জন্ম দেবে। এখানে স্পষ্টভাবে বর্তমান গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অতএব আরও স্পষ্টীকরণসহ উপরিউক্ত ধারা যুক্ত করা আবশ্যক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কোনো পরিবর্তন করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর থাকবে কি না? ক্রান্তিকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যাবে, এমন অবস্থার বিষয়ে বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন। গণপরিষদ ভেঙে যাওয়ার পর যিনি গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা অর্জন করতে পারেন এমন ব্যক্তিকে নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিকল্প বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এরকম বাস্তবতায় (ক) সংবিধান অনুযায়ী প্রথম নির্বাচনের শেষ তারিখ সংবিধানে উল্লেখ থাকতে হবে। (খ) সংবিধানের সূচনা থেকেই গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে স্পিকার আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বহাল থাকবেন। (গ) নির্বাচনের পর সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সরকার (মন্ত্রিপরিষদ) সংবিধান প্রদত্ত মন্ত্রিসভার সব ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা প্রয়োগ ও ভোগ করতে পারবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় যেকোনো পরিবর্তন, সংযোজন বা সমন্বয় করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর থাকবে—এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিকল্প বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন । তদুপরি, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতিকে ক্রান্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে একজনকে নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হবে। (ঘ) যদি ওপরের (ক) তে প্রস্তাবিত প্রথম নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব না হয় অথবা যদি প্রথম নির্বাচনের শেষ তারিখটি সংবিধান প্রণয়নের সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে নির্ধারণ করা না যায়, তবে বর্তমান গণপরিষদকে সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত সমস্ত ক্ষমতাসহ ক্রান্তিকালীন সংসদ হিসেবে পরিচালিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত। তবে শর্ত থাকে যে এই জাতীয় সংসদের মেয়াদ কোনো অবস্থাতেই এক বছরের বেশি হবে না এবং এটি নির্বাচনের অন্তত ৩০ দিন আগে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে সংবিধান কার্যকরের এক বছরের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। যেটি বিশেষভাবে বিবেচ্য, দেশকে কোনোভাবেই শূন্য অবস্থায় রাখা বাঞ্ছনীয় নয় এবং ওপরের (ক) অথবা (খ)-তে প্রস্তাবিত বিধান প্রণয়ন করা একান্ত অপরিহার্য।
ড. আবেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
মুন্তাকীম চৌধুরীর জামাতা বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর বড় মেয়ে টিউলিপ চৌধুরীর স্বামী অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। তাঁর বাবা আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর চাচাতো ভাই। অর্থাৎ মুন্তাকীম চৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে থেকেই তাঁরা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। ১৯৮৩ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আবেদ চৌধুরী ও টিউলিপ চৌধুরী।
আবেদ চৌধুরী জানান, তাঁর শ্বশুর দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। এ মুহূর্তে রয়েছেন মেলবোর্ন শহরে। বয়স যেহেতু ৯০ পেরিয়েছে, ফলে শারীরিক অবস্থা খুব ভালো নয়। কিছুটা স্মৃতিভ্রমও হয়েছে। সবকিছু মনে করতে পারেন না।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জাপানে যান, মুন্তাকীম চৌধুরী তখন জাপানের রাষ্ট্রদূত। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, জাপানে মুন্তাকীম চৌধুরীর বাসায় বঙ্গবন্ধুর দুই পাশে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন টিউলিপ চৌধুরী এবং এবং তার ছোট বোন পিওনী চৌধুরী। পিওনী চৌধুরী তাঁর মেয়ে সামারা চৌধুরীকে নিয়ে বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।
আবেদ চৌধুরী জানান, মুন্তাকীম চৌধুরী ছিলেন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত। প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন মনোরঞ্জন ধর। জাপানের সঙ্গে এখন বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন মুন্তাকীম চৌধুরী।
টোকিওতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরীর দুই মেয়ে টিউলিপ চৌধুরী ও পিওনী চৌধুরী, ১৯৭৩
বাহাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। এরপর তাঁকে জাপানের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়া ও পূর্ব জার্মানিতেও দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সিলেটের আওয়ামী রাজনীতির টানাপোড়ের কারণে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু তাঁকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। এ নিয়ে তাঁর (বঙ্গবন্ধু) মনে আক্ষেপ ছিল। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও সুদর্শন মুন্তাকীম চৌধুরীর জন্য রাষ্ট্রদূতের কাজ অবধারিত ছিল এবং তিনি এই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি মুন্তাকীম চৌধুরী। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে মেয়ের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান।
১. পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে; ২. বড় মেয়ে টিউলিপ চৌধুরী ও নাতির সঙ্গে
আবেদ চৌধুরী জানাচ্ছেন, জাপানের সংসদ সদস্য হায়াকাওয়ার সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরীর সুসম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। মুন্তাকীম চৌধুরীর কাছ থেকে আবেদ চৌধুরী ঘটনাটি শুনেছেন। সেটি হলো, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার সংবাদ শোনার পরে মি. হায়াকাওয়া ভীষণ মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে একটি হাইকু (একধরনের জাপানি কবিতা) লিখে সেটি পড়েন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবেদ চৌধুরীর ভাষায়, তার শ্বশুর মুন্তাকীম চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে জাপান ও কোরিয়ার বন্ধুত্ব স্থাপনের ‘আর্কিটেক্ট’। রাজধানী ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁও তৈরি হয় হাওয়াকাওয়ার উদ্যোগে, যেখানে বড় ভূমিকা রাখেন মুন্তাকীম চৌধুরী। বাংলাদেশে পোশাক খাতেরও অন্যতম উদ্যোক্তা মুন্তাকীম চৌধুরী।
মুন্তাকীম চৌধুরীকে ‘প্রচারবিমুখ’ মানুষ উল্লেখ করে আবেদ চৌধুরী বলছেন, তিনি যখন শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন, তখনও খুব বেশি জনসমক্ষে আসতেন না। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয় এড়িয়ে চলতেন। রাজনীতিতে গিয়ে নিজের প্রচারে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর দুই সন্তানও রাজনীতিতে যুক্ত হননি।
(সংবাদপত্রের ছবিগুলো আব্দুল মুক্তাদির জুবেদ চৌধুরীর ছেলে মেজর (অব.) নুরুল মান্নান চৌধুরীর সৌজন্যে)।
তথ্যসূত্র: আমীন আল রশীদ, সংবিধান প্রণেতাগণ, শিলালিপি/২০২৩।