যে ঘোষণাপত্র এদিন পাঠ করা হবে বলে শোনা যাচ্ছিলো, তার একটি কপি দুদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায় অথবা ছড়িয়ে দেওয়া হয় পাবলিকের পালস বোঝার জন্য। কিন্তু তারপরও এদিন সত্যিই কী ঘোষণা দেওয়া হবে; সংবিধান বাতিল করে একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হবে কি না; যদি এরকম ঘোষণা আসে তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া কী হবে; সেনাবাহিনীই বা বিষয়টিকে কীভাবে নেবে— এসব নিয়ে জনমনে যখন নানা প্রশ্ন ও সংশয় তৈরি হচ্ছিলো এবং এই কর্মসূচি ঘিরে কোনো নাশকতা ঘটে কি না বা ঘটানো হয় কি না— তা নিয়েও উদ্বেগ ছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানের ঠিক আগের রাতে দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে একটি লিখিত বক্তব্যও দেওয়া হয় এরকম: ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে। আমরা আশা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।’
এই ব্রিফিংয়ের পরেই ধারণা করা হয় যে ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে শহীদ মিনার থেকে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পেশ করার কর্মসূচি হয়তো বাতিল হয়ে যাবে, না হয় কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনা হবে। প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক ঘোষণা করেছিলেন যে মঙ্গলবার বিকেলের কর্মসূচি বহাল রয়েছে। কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হচ্ছিলো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠকে বসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তার মানে কর্মসূচি নিয়ে তাদের মধ্যে একধরনের অনৈক্য বা মতভেদ তৈরি হয়েছিল।
রাত ২টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ৩১ ডিসেম্বরের কর্মসূচি হবে। তবে সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে না। কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘মার্চ ফর ইউনিটি’। অর্থাৎ ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’ কর্মসূচি পরিণত হয় ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিতে।
৩১ ডিসেম্বর কী হলো?
নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ জুলাই ঘোষণাপত্র চায়। তারা সংস্কার চায়, নতুন সংবিধান চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার ঘোষণা দিয়েছে, তখন সরকার সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি বিজয়।’ নতুন সংবিধানের জন্য আগামী নির্বাচন গণপরিষদ নির্বাচন হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কেন কর্মসূচি পরিবর্তন?
গত ৮ অগাস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার যে খুব স্বস্তিতে আছে, তা বলার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে এই সরকারকে। যারা উপদেষ্টা পরিষদে আছেন তাদের অনেককে নিয়ে জনমনে প্রশ্নও আছে। রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে এটিকে কেন একটি জাতীয় সরকারে রূপ দেওয়া গেল না সেসব প্রশ্নেরও সদুত্তর নেই। ফলে দেশ চালাতে গিয়ে সরকার যে হিমশিম খাচ্ছে এবং গত প্রায় পাঁচ মাসে কোথাও যে পুরোপুরি স্বস্তি ফিরিয়ে আনা গেছে— সরকার নিজেও হয়তো সেটি দাবি করবে না। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে সংবিধান বাতিল করে বিপ্লবী সরকার গঠন করলে সেটি আরও বড় সংকটের জন্ম দেবে কি না এবং তাতে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে— সেসবও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এসব কারণে অনেকে মনে করেন, সরকার অত্যন্ত কৌশলে পরিস্থিতি এমনভাবে মোকাবেলা করলো যাতে এই ইস্যুতে দেশের ভেতরে নতুন করে আরেকটি সংকটের জন্ম না হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেহেতু সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীজন, ফলে তারাও নিশ্চয়ই এমন কোনো কাজ করবে না, যা সরকারকে বিব্রত করে কিংবা সরকারের দেশ পরিচালনা আরও বেশি কঠিন করে তোলে।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএনপি কোনো ধরনের বৈপ্লবিক কর্মসূচিতে সমর্থন দিচ্ছে না। যেমন রাষ্ট্রপতিকে সরানো যায়নি বিএনপির আপত্তির কারণে— এটি ওপেন সিক্রেট। তাছাড়া বিএনপি এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি। অন্তত ভোটের হিসাবে। আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে তারাই যেহেতু সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং জুলাই অভ্যুত্থানেও তাদের বড় ভূমিকা রয়েছে, ফলে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বড় স্টেকহোল্ডার। অতএব তারা যা চায় না বা যে কর্মসূচিতে তাদের সমর্থন নেই, সেরকম কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা কঠিন। সেটি সরকারের জন্য এবং সরকারের অন্য স্টেকহোল্ডারদের জন্যও।
এসব কারণেই হয়তো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের কর্মসূচিটি বাতিল না করে একটি মধ্যবর্তী অবস্থানে থেকেছে। তাছাড়া মধ্যরাতে কর্মসূচি বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হলে সেটি অন্য সমস্যা তৈরি করতো। কেননা ততক্ষণে দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেকেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন, অনেকে পৌঁছেও গিয়েছেন। কর্মসূচি প্রত্যাহার করলে সেটিকে তাদের আত্মসমর্পণ বা পিছটান হিসেবেও দেখা হতো। সে হিসেবে তারা ঘোষণাপত্র জারির কর্মসূচি বাদ দিয়ে যে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ নাম দিয়ে বিরাট গণজমায়েত করলো, সেটি বরং তাদের পরিপক্কতা হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত।
এই কর্মসূচির তাৎপর্য কী?
‘মার্চ ফর ইউনিটি’র মধ্য দিয়ে মূলত তিনটি ঘটনা ঘটলো।
১. জুলাই প্রোক্লেমেশনে সংবিধান বাতিল ও বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলে একটি নতুন সংকটের জন্ম হতো। বিশেষ করে বিএনপি এবং আরও একাধিক দল এই বিষয়টি হয়তো নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করত। ফলে একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারতো। অতএব সেরকম একটি পরিস্থিতি এড়ানো গেছে।
২. যেহেতু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে এবং এরইমধ্যে তারা সারা দেশে কমিটি গঠনের কাজও শুরু করে দিয়েছে, ফলে শহীদ মিনারের এই জমায়েতের লক্ষ্য পরিবর্তন করা হলেও তাদের জন্য এটি একটি উদ্বোধনী শোডাউন হিসেবে কাজ করবে। তাদের সঙ্গে কত লোক আছে, তার একটা খসড়া হিসাবও হয়তো পাওয়া গেলো। যদিও এদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াত শিবিরের সদস্য সম্মেলন ছিল এবং ধারণা করা হচ্ছে যে, ওই সমাবেশ থেকেও প্রচুর লোক শহীদ মিনারের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নিজস্ব কত হাজার বা কত লাখ লোক সেখানে এসেছিলেন, সেই হিসাব বের করা কঠিন। কিন্তু তারপরও এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় জমায়েত এবং যেকোনো রাজনৈতিক দল গঠনের আগে এই ধরনের একটা শোডাউনের তাৎপর্য আছে।
৩. যে ঘোষণাপত্রটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে এবং যেটি ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনার থেকে পাঠ করার কথা ছিল বলে শোনা যায়, সেটি আপাতত ঘোষণা করা না হলেও এর মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের একটা রূপরেখা পাওয়া গেছে। এটিকে তাদের দলের গঠনতন্ত্রের মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনা হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। অর্থাৎ তারা কী ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা চায়— তার একটি ইঙ্গিত এখানে রয়েছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার যে ঘোষণাপত্রই তৈরি করুক না কেন বা তার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির এই ঘোষণাপত্রের মিল-অমিল যা-ই থাকুক না কেন, এর মধ্য দিয়ে এই দুটি সংগঠনের রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেলো— এটিও ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।