এ. কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ(১৯১৭—১৯৯৫)
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় ও দয়াময়ের নামে’ যুক্ত করা; ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দল থেকে বহিষ্কৃত হলে সংসদ সদস্য পদ চলে যাওয়ার বিধান বাতিল করা এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ ইস্যুতে সুনির্দিষ্টভাবে দুটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন এ. কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ। সংবিধানে ‘ন্যায়পাল’ বিষয়ক অনুচ্ছেদটিও মূলত তাঁর তৈরি করা। ফলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন: ‘আকন্দ সাহেব, আপনি হবেন আমার প্রথম ন্যায়পাল।’ প্রখ্যাত এই আইনজীবী বয়সে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে তিন বছরের বড় ছিলেন। সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির সদস্যদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ। ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলেন হাফেজ হাবীবুর রহমান (জন্ম ১৯১৫)।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
মোশাররফ হোসেন আকন্দ ১৯১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলাধীন রামচন্দ্রপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম হাজী অলি আকন্দ। মা নুরজাহান বেগম।
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহ মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে। প্রসঙ্গত, এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য আবদুর রউফ (২৫ মার্চ ১৯৪২—২৯ নভেম্বর ২০১১)। মোশাররফ হোসেন আকন্দ প্রাথমিক বৃত্তি পাওয়ার পর ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকে ১৯৩৩ সালে এন্ট্রাস পাশ করেন। স্কুল জীবনে তিনি হাজী মো. মহসিন বৃত্তিও লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্ত্বের সাথে ১৯৩৯ সালে অর্থনীতিতে এম.এ এবং ১৯৪২ সালে এল.এল.বি ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনে খ্যাতিমান আইনজীবী
এ. কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ পড়ালেখা শেষ করে ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহ আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি Court of Wards এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬-১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারি কৌঁসুলী হিসেবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। আইনজীবী হিসেবে তিনি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে গরিব মানুষের জন্য বিনা পারিশ্রমি অথবা নামমাত্র ফি নিয়ে আইনি সহায়তা দেয়া, মামলা না নিয়ে দুপক্ষকে ডেকে মীমাংসা করে দেয়ার মতো ঘটনায় তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।
রাজনীতি: সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়
নিজ বাড়িতে মোশাররফ হোসেন আকন্দ
এ. কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ফুলপুর-হালুয়াঘাট নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-৬ আসন (জাতীয় পরিষদ-৮১) থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসনে মোট ভোটার ছিলো ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৯০ জন। তিনি পেয়েছেন ৪০ হাজার ৫২৮ ভোট। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ময়মনসিংহ জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা ফয়জুর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধ: প্রথম সন্তানের মরদেহটিও পাননি
মোশাররফ হোসেন আকন্দ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে নানা জায়গায় সফর করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে তিনি বিভিন্ন ক্যাম্প ও উদ্বাস্তু শিবির ভ্রমণ করেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের বিভিন্ন বার কাউন্সিল ও চেম্বার অব কমার্সে যান তহবিল গঠনের জন্য। তাঁর বড় ছেলে ক্যাপ্টেন মাহমুদ হোসেন আকন্দ (ইএমই) চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে দায়িত্বরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই তিন দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে হাউজ অ্যারেস্ট করে এবং এপ্রিল মাসে অমানুষিক নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর মরদেহটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শহীদ ক্যাপ্টেন মাহমুদের বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার এই বীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশ করে।
গণপরিষদ: ন্যায়পাল সৃষ্টির প্রস্তাব
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এ. কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ। মূলত একজন খ্যাতিমান আইনজীবী ও একাডেমিশিয়ান হিসেবে তাঁকে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানে ‘ন্যায়পাল’ পদ সৃষ্টির বিধান যুক্ত করা হয় তাঁর পরামর্শে। তাঁর ছেলে মাসুদ আলম আকন্দ বলেন: ‘বঙ্গবন্ধু আব্বাকে বলেছিলেন, আকন্দ সাহেব আপনি হবেন আমার প্রথম ন্যায়পাল।’ সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে সংবিধানে স্বাক্ষর করার আগে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করেন।
মোশাররফ হোসেন আকন্দের নোট অব ডিসেন্ট
১৯৭২ সালের ১০ জুন তিনি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান বরাবর যে নোট অব ডিসেন্ট-সম্বলিত চিঠি দেন সেখানে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন। এগুলো হচ্ছে:
১। সংবিধানের প্রস্তাবনা এই শব্দগুলির সমন্বয়ে রচনা করতে হবে: “সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় ও দয়াময়ের নামে।’’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতির চারটি মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা যার অর্থ নাস্তিকতা নয়। বাঙ্গালীরা স্বভাবতঃই ধর্মভীরু জাতি; বিশেষ করে বাংলাদেশের শতকরা তেরাশী ভাগ লোক মুসলমান যারা সাধারণত সকল কাজই সর্বশক্তিমান আল্লার নামে আরম্ভ করেন। সেজন্য ‘‘সর্বশক্তিমান.. দয়াময়ের নামে’’ এই শব্দগুলি লিপিবদ্ধ হলে দেশের বহু লোকের উপর কিছু রাজনৈতিক প্রভাব পরিলক্ষিত হবে। পক্ষান্তরে, মিশরসহ বহু সমাজতান্ত্রিক দেশ ইসলামকেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেছে।
প্রসঙ্গত, মোশাররফ হোসেন আকন্দের ছেলে মাসুদ আলম আকন্দ বলেন, ‘সংবিধানের শুরুতে পরম করুণাময়ের নামে লেখার বিষয়টি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আব্বার আলাপ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, আকন্দ সাহেব এ বিষয়ে আমি আপনার সাথে একমত। আমার সাথে মনিদা (কমরেড মনি সিং), ধর বাবুরা (মনোরঞ্জন বাবু) এসেছেন। সৌদি আরব, ইরানসহ মুসলিম দেশগুলো এবং পশ্চিমা বিশ্ব মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে। অপরদিকে ভারত ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আমাদের সহযোগিতা করে পাশে ছিল এবং আছে। এ মুহূর্তে যদি সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করি, তাহলে মিত্রদের কাছে ভুল সংকেত যাবে। যা সঠিক হবে না। উপযুক্ত সময়ে আমরা সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ অবশ্যই সংযোজন করবো।’
২। অনুচ্ছেদ ৪২। আইন দ্বারা সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ সাপেক্ষে নীতিগতভাবে আমরা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা মেনে নিয়েছি। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে দখল করতে হবে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্রকে বাধ্যতামূলক দখলের দুটো স্পস্ট নীতি গ্রহণ করতে হবে। তা হচ্ছে (ক) সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয়করণের জন্য বাধ্যতামূলক দখল। এই ব্যাপারে ক্ষতিপূরণসহ বা বিনা ক্ষতিপুরণে যেকোনো সম্পত্তি, যেকোনো পরিমাণে রাষ্ট্রীয়করণের পূর্ণ অধিকার রাষ্ট্রের হাতে থাকতে হবে এবং এই অধিকারের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা চলবে না। (খ) দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রীয়করণের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক দখল, অর্থাৎ জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য যেমন হাসপাতাল, অনাথাশ্রম ইত্যাদি, এই ধরনের দখল হতে হবে কেবলমাত্র গণ-অভীষ্টসিদ্ধির উদ্দেশ্যে এবং সেজন্য ক্ষতিপুরণও দিতে হবে। এইরূপ দখল আদালতের এখতিয়ারভুক্ত হবে।
৩। অনুচ্ছেদ ৭০-এ বর্ণিত মতে রাজনৈতিক দল হইতে বহিষ্কারের ফলে সংসদের সদস্যপদ বাতিলের জন্য বিধানটি বর্জন করতে হবে। কারণ এর ফলে রাজনৈতিক দলের মধ্যে অবাঞ্চিত ঈর্ষা ও কোন্দলের সৃষ্টি হবে, যার ফলে দলে ভাঙন সৃষ্টি হবে। এতে দলের মধ্যে কেবল অবিশ্বাস ও বীতশ্রদ্ধার সৃষ্টি হবে।
উল্লেখ্য, ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরও তিনজন সদস্য (হাফেজ হাবীবুর রহমান, আসাদুজ্জামান খান ও আব্দুল মুন্তাকিম চৌধুরী) নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন।
বাহাত্তর পরবর্তী জীবন
২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টের সম্মাননা গ্রহণ করছেন ছেলে মাসুদ আলম আকন্দ
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোশাররফ হোসেন আকন্দ ময়মনসিংহ সদর ও মুক্তাগাছা নিয়ে গঠিত ময়নসিংহ-১৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৬৩ জন। তিনি পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪ ভোট। এখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ন্যাপের ডাকসাইটে নেতা আলতাফ আলী। প্রসঙ্গত, আকন্দ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরর সঙ্গেও সদ্ভাব বজায় রাখতেন। তবে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে তাঁকে দলীয় পদ এমনকি মন্ত্রিত্বের অফার দেয়া হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।
সততা ও নৈতিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
১. ছেলের জীবনের বিনিময়ে বাড়ি নয়: ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শহীদ পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকার মোশাররফ হোসেন আকন্দকে ঢাকা শহরে একটি বাড়ি উপহার দেয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এই সৎ ও নির্লভ রাজনীতিবিদ সেটি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর ছেলে মাসুদ আলম আকন্দের ভাষায়: ওই সময়ের রাজনীতিবিদরা যে ধরনের নীতি-নৈতিকতা মেনে চলেছেন, সেটি আজকের বাংলাদেশে রূপকথার গল্পের মতো মনে হবে। আপনি ভাবুন রাজধানীর ইস্কাটনের মতো জায়গায় একটি বিশাল বাড়ি প্রত্যাখ্যান করা কি খুব সহজ কথা? আব্বা বঙ্গবন্ধুকে বললেন: ‘‘মাই সান ইস মাচ মোর প্রেশিয়াস দ্যান আ হাউজ।’’ ছেলের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। পতাকা পেয়েছি। তার জীবনের বিনিময়ে একটা বাড়ি হতে পারে না।’ প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু সরকার ওই সময়ে আরও অনেক শহীদ পরিবারকে বাড়ি দিয়েছিলো। সম্মানার্থে। মোশাররফ হোসেন আকন্দ সেটা গ্রহণ করেননি। তার অর্থ এই নয় যে তিনি বঙ্গবন্ধুকে খাটো করেছেন। বরং শহীদ সন্তানের পিতাকে বাড়ি দিতে চাওয়াটা যেমন ছিলো বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা, তেমনি সেটি গ্রহণ না করাটাও ছিলো মোশাররফ হোসেন আকন্দের উদারতা।
২. যে কারণে অনুপস্থিত থাকলেন সিন্ডিকেট সভায়: মোশাররফ হোসেন আকন্দ তখন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য। শিক্ষকদের পদোন্নতি বিষয়ক একটি সভায় তাঁর যোগ দেয়ার কথা। কিন্তু তিনি জানতে পারলেন যে, পদোন্নতির তালিকায় থাকা শিক্ষকদের মধ্যে তাঁর এক আত্মীয় রয়েছেন। ফলে তিনি ওই সভায় উপস্থিত থাকতে না পারার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর একটি চিঠি লিখলেন। তিনি লিখলেন, আমি জানতে পারলাম যে, পদোন্নতি প্রত্যাশী শিক্ষকদের মধ্যে আমার এক আত্মীয় রয়েছেন। ফলে নৈতিকভাবে আমি এই সভায় যোগদান করতে পারছি না।
৩. রক্ষী বাহিনী যখন ছেলেকে ধরে নিয়ে গেলো: সদ্য স্বাধীন দেশ। মোশাররফ হোসেন আকন্দ তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে ময়মনসিংহ শহরে বসবাস করছেন। তখন রক্ষী বাহিনীর বেশ দাপট। ছেলে মাসুদ আলম আকন্দ একদিনের ঘটনা বলছেন: আমরা তখন ময়মনসিংহ শহরের ২ নম্বর কালিবাড়ি রোডে থাকি। হঠাৎ শোরগোল শুরু হলো যে রক্ষী বাহিনী আসছে। একটা ত্রাসের সৃষ্টি হলো। তারা রাস্তার দুইপাশ ধরে আসতে থাকলো। আর পথে যাকে পাচ্ছে তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকেও ধরলো। তখন আব্বাও বাসার সামনে বেরিয়ে এলেন। রক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য আব্বাকে স্যালুট করলেন। আব্বা তার কুশল জিজ্ঞেস করলেন। তিনি তখনও জানেন না যে আমাকে তারা ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের একজন প্রতিবেশি গিয়ে আব্বাকে বললেন মাসুদকে তো ধরে নিয়ে গেছে। আব্বা নির্লিপ্ত। উত্তেজিত হলেন না। বললেন, আমার ছেলে যদি কোনো অন্যায় করে, তাহলে তার শাস্তি হবে। আর যদি সে অন্যায় করে না থাকে, যদি তাকে অহেতুক ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতন করে, তাহলে দায়ীদের শাস্তি হবে। মাসুদ বললেন, কিছুদূর যাওয়ার পরে রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা তাকে ছেড়ে দেয়।
৪. বেশি ফি নেয়া যাবে না: মোশাররফ হোসেন আকন্দ ছিলেন একজন নির্লোভ মানুষ। অনেক টাকা-পয়সা উপার্জন করতে হবে—এমন ভাবনা তাঁর ছিল না। এমনকি একজন সিনিয়র আইনজীবী হওয়ার পরও তিনি মক্কেলদের কাছ থেকে খুব বেশি ফি নিতেন না। ময়মনসিংহ বার কাউন্সিল আয়োজিত শোকসভায় মোশাররফ হোসেন আকন্দের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর জুনিয়র অ্যাডভোকেট ওয়াহেজ উদ্দীন জানান, একবার একজন মক্কেলের কাছ থেকে তুলনামূলক বেশি ফি নেয়ায় সেটি ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। মোশাররফ হোসেন আকন্দ বলতেন, নেহায়েত বিপদে না পড়লে মানুষ ডাক্তার ও উকিলের কাছে যায় না। সুতরাং বিচার প্রার্থীদের কাছ থেকে বেশি ফি নেয়া অনৈতিক। আইনজীবীদের সেবার মানসিকতা থাকতে হবে। কোর্ট হচ্ছে ন্যায়ালয়। তিনি তাঁর জুনিয়রদের পরামর্শ দিতেন, মানুষ যখন মামলা নিয়ে আসবে, প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে যে তাঁর আর্থিক অবস্থা কেমন? যদি বলে যে জমি বা গরু বিক্রি করে মামলার খরচ জোগাবে, তাহলে তার মামলাটি বিনা পয়সা করে দেবে না হয় মামলাটি নেবে না।
অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা, তারিক আল নূর, আসফ আলি আশকারি প্রমুখ আইনজীবী মোশাররফ হোসেন আকন্দ সম্পর্কে এই তথ্যগুলো দিয়েছেন।
ছেলে মাসুদ আলম আকন্দ জানান, মোশাররফ হোসেন আকন্দ অনেক সময় মামলা না নিয়ে দুপক্ষকে ডেকে মীমাংসা করে দিতেন—যাতে আদালতে গিয়ে দুপক্ষেরই অর্থ ও সময় নষ্ট না হয়। এতে অনেক সময় তাঁর সহকর্মী আইনজীবীরা মন খারাপ করতেন। কারণ একটা মামলা নেয়া গেলে উকিল তো ফি পাবেন। কিন্তু তাঁরা আব্বারর ব্যক্তিত্বের সামনে কিছু বলার সাহস পেতেন না।
৫. মামলার আদালত পরিবর্তন: মোশাররফ হোসেন আকন্দ ময়মনসিংহ আদালতে প্র্যাকটিস করতেন। একসময় ওই আদালতে সিনিয়র সাব জজ হিসেবে বদলি হন মো. শাহনেওয়াজ (পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনার)। মোশাররফ হোসেন আকন্দ তাঁর আপন নানা শ্বশুর। তিনি একটি ঘটনা বললেন: ‘একদিন আমার নানা শ্বশুর দুটি কেসের নম্বর দিয়ে বললেন—এই দুটি মামলা আমার নিজের। তোমার কোর্ট থেকে অন্য কোর্ট থেকে পাঠিয়ে দাও। পরে আমি আদালতে গিয়ে মামলা দুটির নথি এনে দেখি, ওই দুটি মামলা আমার আদালতে শুনানির জন্য দুই তিনবার এসেছে। শুনানির জন্য প্রতিবারই প্রতিপক্ষ প্রস্তুত ছিল। কিন্তু বাদীপক্ষ বারবার সময় নিয়েছে। তখন আমি প্রতিপক্ষের আইনজীবী আনিসুর রহমান খানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো জানতেন মোশাররফ হোসেন আকন্দ আমার আপন নানা শ্বশুর। তারপরও কেন প্রতিবার আমার কোর্টে শুনানির জন্য আপনারা প্রস্তুত থাকতেন? জবাবে আনিসুর রহমান খান বললেন: আমি জানতাম আকন্দ সাহেব কখনো আপনার আদালতে মামলা রাখবেন না। সে কারণে আমরা হাজিরা দিতাম। কিন্তু আমরা জানতাম আকন্দ সাহেব আসবেন না। এই ঘটনা শুনে দুই আইনজীবীর প্রতিই আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।’
৬. বই পড়ায় মগ্ন: মোশাররফ হোসেন আকন্দ ছিলেন স্বল্পভাষী। সারাক্ষণ বইয়ের ভেতরে ডুবে থাকতেন। বইয়ের ভেতরে তিনি এতটাই মগ্ন থাকতেন যে, ছেলেমেয়েরা টাকা চাইতে এলে তিনি ইশারায় ড্রয়ার দেখিয়ে দিয়ে বলতেন ওখান থেকে নিয়ে যাও। মাসুদ আলমের ভাষায়: আমরা ভাইবোনরা গল্প করতাম যে আব্বা আজকে কার সাথে কথা বলেছে? কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক আলী নেওয়াজ। আব্বার খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তিনি বাসায় আসতেন। আব্বার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন। আব্বা চুপ করে শুনতেন। উত্তর দিতেন খুব কম। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা মন্তব্য করতেন। প্রসঙ্গত, তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। ময়মনসিংহ ল-কলেজ স্থাপনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা স্থাপন ও উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি ময়মনসিংহ রাইফেলস ক্লাবের কার্যকরি কমিটির সদস্য ছিলেন।
পারিবারিক জীবন
ময়মনসিংহের বাড়ির সিঁড়িতে স্ত্রী জেবুন্নেসা আকন্দের সাথে মুশাররফ হোসেন আকন্দ
মোশাররফ হোসেন আকন্দের স্ত্রীর নাম জেবুন্নেছা আকন্দ। এই দম্পতির তিন ছেলে (বড় ছেলে মাহমুদ হোসেন আকন্দ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ)। মেজ ছেলে মনসুর আলম আকন্দ পেশায় ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে মাসুদ আলম আকন্দ অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী। তাঁর পাঁচ মেয়ের মধ্যে তিনজনই ছিলেন শিক্ষক। তাঁরা হলেন মৌসুফা আখতার, মাজেদা আখতার খাতুন ও মাসুদা বেগম। বাকি দুই মেয়ে মাহমুদা বেগম ও মনোয়ারা বেগম গৃহিণী।
অসুস্থতা, মৃত্যু ও দাফন
মোশাররফ হোসেন আকন্দ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আইন পেশায় সক্রিয় ছিলেন। তবে শেষদিকে আদালতে কম যেতেন। ছেলে মাসুদ বলছেন, ‘আদালত বন্ধ হলেই আব্বা আমার কাছে চলে আসতেন। তাতে যেখানেই চাকরি করেছি। সবশেষ তিনি যখন আমার কর্মস্থল খুলনায় এলেন, তখন শরীরটা বেশ খারাপ। আমি প্লেনের টিকিট করে দিলাম। যশোর থেকে গাড়িতে নিয়ে এলাম খুলনায়। বাসায় থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে খুলনা মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানেই ১৯৯৫ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি মারা যান। খুলনায় প্রথম জানাজা দিয়ে মরদেহ ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হয়। ময়মনসিংহ আদালত চত্বরে তাঁর জানাজা হয়। তাঁর সম্মানে এদিন আদালতের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তিনিই প্রথম আইনজীবী, ময়মনসিংহ আদালতে যাঁর জানাজা হয়েছে। এখান থেকে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রামচন্দ্রপুরে গ্রামের বাড়িতে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।