সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের ক্ষতিপূরণকে প্রশ্নাতীত রাখার বিধান যুক্ত হয় শওকত আলী খানের প্রস্তাবে

শওকত আলী খান (১৯২৬—২০০৬)

একজন নাগরিক কতটুকু ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন করতে পারবেন, রাষ্ট্র তার সীমারেখা ঠিক করে দেবে কি না; টাকা থাকলেই যে কেউ নিজের ইচ্ছেমতো জমির মালিক হতে পারবেন কি না—এই তর্কটি শুধু আজকের নয়, ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদেও উঠেছিল। তবে সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া না হলেও রাষ্ট্র যেকোনো সময় যেকারো সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারবে বলে বিধান করা হয়। যদিও সেখানে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি শুরুতে স্পষ্ট ছিল না। এমতাবস্থায় ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি প্রশ্নাতীত রাখার জন্য সংবিধানে একটি দফা যুক্ত করা হয় যার প্রস্তাবে, তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য শওকত আলী খান। একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। বিচার বিভাগের প্রতি যাঁর ছিল দারুণ শ্রদ্ধাবোধ আর আইনজীবীদের প্রতি ছিল প্রগাঢ়  ভালোবাসা। দল-মত ও বয়স নির্বিশেষে সকল আইনজীবীকে তিনি ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

জাতীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত সংসদ সদস্যদের জীবনী ১৯৭৫-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শওকত আলী খানের জন্ম ১৯২৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার কহেলা গ্রামে, মামার বাড়িতে। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি গ্রামে। তাঁর পিতা আরফান আলী খান ছিলেন ব্রিটিশ আমলে একজন সুপরিচিত ব্যবসায়ী। শওকত আলী খান ছিলেন তাঁর বাবার দ্বিতীয় পুত্র। শৈশব ও কৈশোরের কিছু সময় তিনি ইয়াঙ্গুন (মিয়ানমার), কলকাতা ও ঢাকা শহরে কাটিয়েছেন।

তরুণ আইনজীবী শওকত আলী খান

প্রথম জীবনে তিনি বাবার কর্মস্থল মিয়ানমারের রেঙ্গুনে পড়ালেখা করেন। ১৯৪২ সালে তিনি রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি স্কুল থেকে ইতিহাস, পদার্থ ও রসায়ন বিষয়ে ডিস্ট্রিংশনসহ এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ডিস্ট্রিংশনসহ বিএসসি পাশ করার পরে লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে বার এট ল ডিগ্রি নেন। পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে এবং ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন শীর্ষ আইনজীবী ছিলেন।

ন্যাপের হাত ধরে রাজনীতিতে

শওকত আলী খান ন্যাপ (ভাসানী)-এর প্রতিষ্ঠাকালীন কোষাধ্যক্ষ। ষাটের দশকে ন্যাপের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘জনতা’র প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ইংরেজি সাপ্তাহিক The New world- এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকে তিনি রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে ডিটেনশন দেয়া হয়। এ সময় তাঁর স্ত্রী বিজয়া শওকত আলী উচ্চ আদালতে যান এবং স্বামীকে ‍মুক্ত করে নিয়ে আসেন। ১৯৬৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে টাঙ্গাইল-২ (জাতীয় পরিষদ ৭২) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। এই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮৮ জন। শওকত আলী খান পেয়েছেন ৯১ হাজার ৫৩৭ ভোট।

মুক্তিযুদ্ধ

শওকত আলী খান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাতে তিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। সেখানে আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে নিজ এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। পরদিন নিজ গ্রাম লাউহাটীতে চলে আসেন। একজন সংসদ সদস্য হয়েও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১-এর আগস্ট মাসে ভারতের মহেন্দ্র গঞ্জের মাইনারচর থেকে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা বাহিনীর একটি কোম্পানিসহ দেশের ভেতরে আসেন যুদ্ধের জন্য। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

গণপরিষদে শওকত আলী খান

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে যে সংবিধান গৃহীত হয় সেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া না হলেও রাষ্ট্র যেকোনো সময় যে কারো সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারবে বলে বিধান করা হয়। যদিও সেখানে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি শুরুতে স্পষ্ট ছিল না।

এমতাবস্থায় শওকত আলী খানের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি প্রশ্নাতীত রাখার জন্য সংবিধানে একটি দফা যুক্ত করা হয়।

সম্পত্তি অর্জনের অধিকারসম্পর্কিত সংবিধানের ৪২ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা নিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।’

গণপরিষদে অনুচ্ছেদটি এভাবেই পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু এই অনুচ্ছেদের ওপর সংশোধনী আনেন শওকত আলী খান এবং তাঁর বক্তৃতার পরে আইন ও সংবিধান প্রণয়ন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, সংশোধনীটি গ্রহণ করা যায়। তখন ডেপুটি স্পিকার বায়তুল্লাহ প্রস্তাবটি ভোটে দিলে এটি কণ্ঠভোটে পাশ হয়।

শওকত আলী খান এই অনুচ্ছেদে একটি নতুন দফা যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। সেটি এরকম: (২) এই অনুচ্ছেদের (১) দফার অধীন প্রণীত আইনে ক্ষতিপূরণসহ বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখলের বিধান করা হইবে এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ কিংবা ক্ষতিপূরণ নির্ণয় ও প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা হইবে; তবে অনুরূপ কোনো আইনে ক্ষতিপূরণের বিধান অপর্যাপ্ত হইয়াছে বলিয়া সেই আইন সম্পর্কে কোনো আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’

তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে সম্পত্তির তিন রকম মালিকানা দেওয়া হয়েছে। একটা রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা, দ্বিতীয়টা সমবায়-মালিকানা, তৃতীয়টা ব্যক্তিগত মালিকানা। ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পত্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানায় রূপান্তরের পদ্ধতি সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে এবং সেই পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এখানে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, সে কথা বলা হয় নাই। ক্ষতিপূরণ দিয়ে সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা যাবে এবং ক্ষতিপূরণ ছাড়া সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা যাবে।

ক্ষতিপূরণ ছাড়া সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা যাবে কিনা সে সম্বন্ধে আমি একটা কথা উল্লেখ করতে চাই: State’s authority to acquire or requisition property situated within its jurisdiction is based on the age-old principles of salus populi (let the welfare of the state be final law)…and of necessitas publica (public interest is greater than private).

অর্থাৎ, জনগণের স্বার্থ ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থের ঊর্ধ্বে। ইউরোপ, আমেরিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত করার জন্য যে বিধান আছে, তাতে কী আছে, দেখা যাক: It is a right inherent in every sovereign to take and appropriate private property belonging to individual citizen for public use. The right which is described as eminent domain in American law is like the power of taxation, the offspring of political necessity, and it is supposed to be based upon an implied reservation by Government that private property acquired by its citizens under its protection may be taken or its use controlled for public benefit irrespective of the wishes of the owner.

অর্থাৎ রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্র জাতীয়করণ করতে পারে সম্পত্তির মালিকের অনুমতি ছাড়াই। এরকম একটা ঘটনা ভারতে ঘটেছিল এবং সে নিয়ে ভারতীয় হাইকোর্টে একটা আপিল হয়েছিল। ভারতীয় হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছিল যে, এটা করা যাবে, কারণ এ সম্বন্ধে ভারতের সংবিধানে বিধান রয়েছে।

তিনি ডেপুটি স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ক্ষতিপূরণ না দিয়ে যদি কোনো সম্পত্তি নেওয়ার কারণ উদ্ভূত হয়, তাহলে সে সম্পত্তি নেওয়া যাবে। বলেন: আদমজী জুটমিল যখন স্থাপিত হয়েছিল, তখন হয়তো ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। সেটার জন্যে যদি ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তাহলে হয়তো ৫০ কোটি টাকা বেশি দিতে হবে এবং সে টাকা দিতে হবে ট্যাক্সের মাধ্যমে। ট্যাক্সের মাধ্যমে না দিলে নোট ছাপিয়ে দিতে হবে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে। যেকোনো উপায়েই দিন না কেন, জনসাধারণের অসুবিধা হবে।

তাঁর এই বক্তব্যের পরে ডেপুটি স্পিকার এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এ ধরনের বিধান রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই সংশোধনী-প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য। এটা গ্রহণ করা যেতে পারে।

বাহাত্তর পরবর্তী রাজনীতি

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি টাঙ্গাইল-৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৯৫৯ জন। শওকত আলী খান পেয়েছেন ৪৭ হাজার ২৭৯ ভোট। এরপরে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেননি।

শওকত আলী খান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং পরে কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি ছিলেন।

আইনজীবীদের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা

ব্যারিস্টার রেহান হোসেন জন্মের পর থেকেই বড় হয়েছেন নিঃসন্তান শওকত আলী খান ও বিজয়া দম্পতির কাছে। পড়াশোনা শেষে করে তিনি শওকত আলী খানের জুনিয়র হিসেবেই ক্যারিয়ার শুরু করেন। আইনজীবী হিসেবে নানাকে কেমন দেখেছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে রেহান হোসেন বলেন: আইনজীবীদের প্রতি তাঁর ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। বয়সে অনেক জুনিয়রকেও তিনি সম্মান করতেন। ভালোবাসতেন। কোর্টের বারান্দায় অনেক দিন তাঁকে দেখেছি কোনো জুনিয়রের টাই ঠিক করে দিচ্ছেন। পুরান ঢাকা থেকে হাইকোর্টে আসার পথে প্রায় প্রতিদিনই নানা রাস্তায় রিকশা বা অন্য কোনো বাহনের জন্য অপেক্ষমাণ কোনো আইনজীবীকে নিজের গাড়িতে তুলে নিতেন।

বিচার বিভাগের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ এতটাই ছিল যে, একবার আমরা কোর্ট শেষ করে বাসায় ফিরছি। হঠাৎ নানা খেয়াল করলেন যে আমরা একজন বিচারকের গাড়ি ওভারটেক করে গেছি। নানা সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে গাড়ি স্লো করতেন বললেন এবং নির্দেশ দিলেন, আমাদের গাড়ি যেন বিচারকের গাড়ির আগে না যায়।

তিনি আদালতে শুনানির সময় অনেক সিরিয়াস বিষয়ে রসিকতা করতেন। তাতে অনেক সময় দেখেছি যে বিচারকরা হেসে দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন জামিন পাওয়া যেকোনো ব্যক্তির অধিকার। জামিন না দেয়াটাই অস্বাভাবিক। একবার একজন বিচারক তাঁকে বললেন যে মি. খান আপনাকে আর সময় দেয়া হবে না। তখন নানা বললেন, My Lord, I will return to you again and ask for time অর্থাৎ আমি পুরোনো আধুলির মতো আপনার কাছে আবারও আসব এবং সময় প্রার্থনা করব। এ কথা শুনে বিচারও হেসে দেন।

তিনি দলমত নির্বিশেষে সকল আইনজীবীকে ভালোবাসতেন। তিনি আমাকেও বলতেন যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কোনো আইনজীবীর প্রতি আমার আচরণ পক্ষপাতমূলক না হয়।

আধুনিক ও স্মার্ট মানুষ

রেহানের ভাষায়: ‘শওকত আলী খান ছিলেন একজন আধুনিক ও স্মার্ট মানুষ। ফ্যাশন সচেতন। তিনি সামাজিক অনুষ্ঠান বা আদালতের বাইরে যেখানে যেতেন, খদ্দরের পাঞ্জাবি ও সাদা পাজামা পরতেন। সাথে স্যান্ডেল। খাঁটি বাঙালিয়ানা। কিন্তু এই মানুষটিই যখন কোর্টে যেতেন, শ্যুটেট বুটেট এবং অবশ্যই ক্লার্কের জুতা। তিনি বলতেন, কোর্টে আইনজীবীদের যে পোশাকটি প্রচলিত, এটা ব্রিটিশদের। যতদিন না এই পোশাক পরিবর্তন করা যাচ্ছে, ততদিন এটার প্রতি সম্মান রাখতে হবে। তাঁকে কখনো ক্লাকের জুতা ছাড়া কোর্টে যেতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’

রেহান বলেন, ‘তাঁর অনেক ড্রামাটিক ব্যাপার ছিল। যেমন একবার আমরা সচিবালয়ে যাব। আমাদের সঙ্গে পাস ছিল না। নিরাপত্তারক্ষীরা গাড়ি আটকালো। নানা বললেন, ‘‘দেশ আমরা আনছি। মারলে মারেন।’’ এই বলে ড্রাইভারকে বললেন ‘‘চলো’’…ঢুকে গেলেন। আসলে ওনার স্পিরিট ছিল অন্যরকম।’

শওকত আলী খান যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, সুইজারল্যাণ্ড, মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, চীন, জাপান, চেকোস্লোভাকিয়া, হল্যাও, কিউবা প্রভৃতি দেশ সফর করেছেন।

সামাজিক কাজ

শওকত আলী খান রাজনীতির বাইরেও নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। তিনি কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লি. এর পরিচালক ছিলেন। তিনি মির্জাপুর প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে জাহানার ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হলে তিনি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তৎকালীন পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের কোষাধ্যক্ষ এবং নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের আজীবন সদস্য, ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টং ক্লাবের সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ রেডক্রস ও যক্ষা সমিতির আজীবন সদস্য, ঢাকা ক্লাব ও ঢাকা রোটারি ক্লাবের সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

বিয়ে ও পারিবারিক জীবন

উপমহাদেশের প্রখ্যাত দানবীর ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দানবীর রনদা প্রসাদ সাহার (রায় বাহাদুরের) বড় মেয়ে বিজয়া সাহাকে বিয়ে করেন শওকত আলী খান। তাঁর নাতি ব্যারিস্টার রেহান হোসেন বলেন, বিয়ের পরে বিজয়া সাহা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও এই পরিবারটি ছিল উদার, মুক্তমনা এবং প্রগতিশীল। ধর্মীয় আচার-আচরণ খুব একটা পালন করা হতো না। তবে দুটি ধর্মের উৎসব সমান মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হতো। শওকত আলী খান ও বিজয়া দম্পতি নিঃসন্তান। তাঁর স্ত্রী বিজয়ার মৃত্যু হয় ২০১৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি।

অসুস্থতা ও মৃত্যু

শওকত আলী খান ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। শেষদিকে কিছুটা ডিমেনশিয়া। মৃত্যুর মাস ছয় আগে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে চলে যান এবং তাঁকে রাখা হয় কুমুদিনী হাসপাতালে। তিনি ছিলেন কুমুদিনি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অন্যতম পরিচালক। হাসপাতালের দিনগুলোয় তিনি কারো সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন না। খুব পরিপাটি মানুষ ছিলেন। কিন্তু শেষদিকে দাড়ি শেভ করতে পারতেন না। শরীরও ভেঙে গিয়েছিল। তিনি এই চেহারাটি কাউকে দেখাতে চাইতেন না। তাঁর নাতি ব্যারিস্টার রেহান হোসেনের ভাষায়: ‘নানার সমস্যাটা ছিল সম্ভবত সুচিত্র সেনের মতো।’ সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দীন সরকার ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। টাঙ্গাইলে হাসপাতালে থাকা অবস্থায় একদিন তিনি শওকত আলী খানকে ফোন করে বললেন: Shawkat I’m coming…শওকত আলী খান বললেন, Don’t come to see me…তারপর ২০০৬ সালের ২৯ জুন রাতে তিনি মারা যান। অনেকটা ঘুমের ভেতরেই। কেননা কিছু সময় আগেও তিনি নার্সদের সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছেন। পরদিন তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয় ঢাকায় এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারম এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের জানাজায় তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবী, তৎকালীন আইমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তৎকালীন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল, আমীর হোসেন আমু অংশগ্রহণ করেন। ওইদিন মাগরিবের নামাজের পরে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায় পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুকে ‘দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি’ বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। (ডেইলি স্টার, ০১ জুলাই ২০০৬)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top