প্রসঙ্গত, এক-এগারোর সরকার নামে পরিচিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে মতবিনিময়ের ভিত্তিতে দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধনসহ অনেকগুলো সংস্কার ধারণা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। ওই অধ্যাদেশে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর ছয় মাসের মধ্যে অনুমোদিত গঠনতন্ত্র কমিশনে জমা দেওয়ারবিধান করা হয়েছিল। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল পর্যায়ের কমিটির সদস্যদের নির্বাচিত হওয়া, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল পর্যায়ের কমিটির শতকরা ৩৩ ভাগ সদস্যপদ নারীদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে আখেরে দলগুলোর ভেতরে কতটুকু গণতন্ত্রায়ন হয়েছে, তা নিয়ে সেই সব তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে যে শব্দগুলো, তার অন্যতম ‘সংস্কার’। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনি ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন ও গণমাধ্যমের মতো বিষয় থাকলেও রাজনৈতিক দল সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠিত হয়নি। বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক দলের সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্রের কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। যে রাজনৈতিক দলের নেতারা দেশ পরিবর্তন করতে চান, সত্যিই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে চান— তাদের দলের ভেতর সংস্কার হবে কিনা বা সেই তাগিদটা তারা অনুভব করেন কিনা, ওই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলের ভেতরে গণতন্ত্রের সংকট দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত একটি বিষয়। কেন দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না, তার পেছনে কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করা যায়। যেমন:
২. দলের ভেতরে নিয়মিত নির্বাচন না হওয়া। দলীয় পদ-পদবি বণ্টনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া না থাকা।
৩. কাউন্সিল হলেও দলীয় প্রধানের ওপর পুরো কমিটি গঠনের দায়িত্ব দিয়ে তার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও আনুগত্যের ঘোষণা প্রকাশ। অর্থাৎ কাউন্সিলে অনেক সময়ই দেখা যায় যে, দলীয় প্রধান নির্বাচিত (মনোনীত) হওয়ার পরে দলের অন্যান্য কমিটি গঠনের দায়িত্বও তার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এটি একটি সামন্তবাদী প্রথা এবং কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দলীয় প্রধান নিজেও এই ধরনের দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখান না। কারণ তিনিও চান এই ক্ষমতাটি তার হাতেই থাকুক।
৫. বিরোধীদলের প্রতি যেমন দমননীতি প্রয়োগ করা হয়, তেমন দলের অভ্যন্তরেও ভিন্নমত দমনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ভিন্নমত পোষণকারী নেতাদের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং এই ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করে।
৬. রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আর্থিক অনুদান প্রদানকারী বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকা অনেক বেশি। বিশেষ করে দলের ভেতরে ব্যবসায়ী এবং অবৈধ উপায়ে উপার্জনকারীদের প্রভাব বেশি থাকে— যা দলের সৎ ও নীতিবান নেতাকর্মীদের নিরুৎসাহিত করে এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। এর ফলে প্রথমত দলের অভ্যন্তরে তরুণ তথা নতুন নেতৃত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়; অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান না হওয়ায় দলগুলো আরও বিভক্ত হয়ে পড়ে; জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চর্চার অবক্ষয় ঘটে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্ন
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন, কেউ কেউ আবার স্বদেশেই আত্মগোপনে আছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এমতাবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেওয়া হলেও তারা অংশ নিতে পারবে কিনা, ওই প্রশ্ন জনপরিসরে আছে।
অনেকেই এটা বলছেন যে, যেরকম অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হলো, তাতে করে তার পক্ষে দলের নেতৃত্ব দেওয়া এখন শুধু কঠিনই নয়, বরং অসম্ভব। কেননা তিনি এরইমধ্যে অনেকগুলো হত্যা মামলার আসামি। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে ফিরলেই তাকে কারাগারে যেতে হবে। বিদেশে বসেও যে তিনি দলের নেতৃত্ব দেবেন, সেটিও খুব সহজ কাজ নয়। তাহলে কি নতুন নেতৃত্ব?
অনেকেই বলছেন, শুধু শেখ হাসিনা নয়, বরং এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে শেখ পরিবারের বাইরে কাউকে নেতৃত্ব নিতে হবে। কিন্তু ওই ব্যক্তিটা কে— এটি এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। তাছাড়া শেখ হাসিনা বা শেখ পরিবারের বাইরে কেউ যদি এখন পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন, তার পরিণতি কী হবে— সেটিও স্পষ্ট নয়। তার মানে যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, ওই সংস্কার এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে আওয়ামী লীগে—যদি তারা বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। যদিও আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে যেহেতু কিছু নেই, ফলে আগামী মাসগুলোয় দেশের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তার ওপরেই অনেক কিছু নির্ভর করবে।
কী বলছেন তারেক রহমান?
পরিবারতন্ত্রকে যদি বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান অসুখ বলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো, আগামী দিনে ওই অসুখ থেকে কি বিএনপি বের হতে পারবে? গত ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের মতো পরিবারতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো থাকবে না। একইসঙ্গে ক্ষমতায় পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার বিধান সংবিধানে যুক্ত করার কথাও বলেন তিনি।
প্রশ্ন হলো, তারেক রহমান কি এই ঘোষণাও দেবেন যে তিনি আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হলেও প্রধানমন্ত্রী হবেন না বা প্রধানমন্ত্রী হলে দলীয় পদ ছেড়ে দেবেন? তার মা বেগম খালেদা জিয়ার পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিংবা লোকদেখানো কাউন্সিলের মাধ্যমে তিনিই দলের প্রধান না হয়ে দলীয় প্রধান পদে সরাসরি ভোট হবে এবং সেখানে একাধিক প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উসৎসাহিত করা হবে? তার পরে তার স্ত্রী বা সন্তানদের কেউ দলের প্রধান হবেন না— এমন ঘোষণা কি তিনি দেবেন?
রাজনৈতিক দলের সংস্কারে করণীয় কী?
১. নিয়মিতভাবে দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন আয়োজন করা।
২. দলের সদস্যপদ দেওয়া থেকে শুরু করে আয়-ব্যয়সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
৩. কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তো বটেই, তৃণমূলের কমিটিগুলোও প্রকাশ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করা। তৃণমূলের কমিটি গঠনের নামে কেন্দ্রীয় নেতাদের বাণিজ্য কঠোর হাতে দমন করা।
৪. দলীয় প্রধানের পদে একাধিক প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে উৎসাহিত করা। এখানে লোকদেখানোর প্রবণতা বন্ধ করা। অমুক পরিবারের অমুক আছেন বলে আর কেউ দলের প্রধান হতে পারবেন না কিংবা কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না, এই জুজুর ভয় দূর করা দরকার এবং এই ভয় দূর করার প্রধান উপায় হলো দলকে পরিবারতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত করা।
৫. ভিন্নমত পোষণকারী সদস্যদের প্রতি সহনশীল মনোভাব এবং ভিন্নমত পোষণে উৎসাহ দেওয়া। স্বয়ং দলীয় প্রধানের সমালোচনাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য না করা।
৬. কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ।
পরিশেষে, যেকোনো রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরই রাজনৈতিক দলের সংস্কারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিন্তু শেষমেষ খুব বেশি সংস্কার হয় না। আবার এই দফায় ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও রাজনৈতিক দল সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠিত হয়নি। সরকার হয়তো চেয়েছে এই সংস্কারটা সংশ্লিষ্ট দলগুলো নিজেরাই করুক। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেই থাকতে হবে। এই সংস্কার বা পরিবর্তন ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে করা সম্ভব নয়।