কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনার নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে ১২ নভেম্বর দুপুরে অস্ত্রের মুখে দুটি ট্রলারসহ ছয় জন বাংলাদেশি মাঝিমাল্লাকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
সংবাদমাধ্যম বলছে, সিমেন্টবোঝাই ট্রলার দুটি সেন্টমার্টিন যাচ্ছিল। যদিও এই তথ্য নিয়ে এরইমধ্যে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কেননা সেন্টমার্টিনের নামে সিমেন্টগুলো মিয়ানমারে পাচার হচ্ছিল বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। এর এক সপ্তাহ আগে গত ৫ নভেম্বর একই এলাকা থেকে আরাকান আর্মি ২০ জন বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে যায় এবং দুদিন পরে বিজিবির মাধ্যমে তাদের ফেরত পাঠায়।
গত ৯ অক্টোবর সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও মিয়ানমারের মাঝামাঝি এলাকায় বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশ থেকে ছয়টি ট্রলারে ৫৮ জেলেকে আটক করে মিয়ানমার নৌবাহিনী। এর মধ্যে মিয়ানমার নৌবাহিনীর গুলিতে একজন নিহত ও দুজন আহত হন। বঙ্গোপসগরের ওই এলাকায় এই ঘটনাগুলো এখন মোটামুটি নিয়মিত।
প্রশ্ন হলো, আরাকান আর্মি কী চায়, তারা কেন বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে কেন আবার ফেরতও দিয়ে দেয়? বঙ্গোপসাগরের যে অংশে বাংলাদেশের অত্যন্ত স্পর্শকাতর সেন্টমার্টিন দ্বীপ অবস্থিত, সেখানে বাংলাদেশের নৌনিরাপত্তা তথা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা জোরদার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের একটা বড় ধরনের কূটনৈতিক ঝামেলা রয়েছে, ফলে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিই বা কতটা শক্তিশালী? আরাকান আর্মির সঙ্গে কি বাংলাদেশ সংঘাতে জড়াবে বা এই ইস্যুটি কি রোহিঙ্গা সংকট বাড়িয়ে তুলবে না কমাবে?
আরাকান আর্মি কারা?
আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যভিত্তিক একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তারা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান (ইউএলএ)-এর সামরিক শাখা। রাখাইনে ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একরকম স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনই তাদের লক্ষ্য।
আরাকান আর্মির কার্যক্রম রাখাইন রাজ্যকেন্দ্রিক হলেও এটি গঠিত হয় চীন সীমান্তবর্তী কাচিন রাজ্যে। তাদের সহায়তা করে আরেক সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাচিন ইন্ডিপেন্ডেস আর্মি।
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি তুলে আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল। ২৬ জন পুরুষকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয় আরাকান আর্মির। শুরুর দিকে ছিল রাখাইন তরুণ ও ছাত্রদের একটি ছোট দল। এ মুহূর্তে আরাকান আর্মির সদস্য সংখ্যা ৩ থেকে ৭ হাজার বলে ধারণা করা হয়।
রাখাইন রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে আরাকান আর্মি ব্যাপক জনপ্রিয় বলে ধারণা পাওয়া যায়। কেননা দারিদ্র এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলা এই রাজ্যে আরাকান আর্মির সংগঠিত হওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। আর এ কারণে মিয়ানমার সরকার ‘আরাকান আর্মি’কে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়মিত অভিযান চালায়।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির সশস্ত্র সংঘাত চলতে থাকে, যা ২০১৯ সালে এসে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। প্রায় দুই বছর যুদ্ধের পর ২০২০ সালের নভেম্বরে উভয়পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
বলা হয়, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় আরাকান আর্মির আধিপত্য রয়েছে। রাজ্যের দক্ষিণের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় মূলত বার্মিজ বামার জনগোষ্ঠীর বাস, যেখানে আরাকান আর্মি ততটা শক্তিশালী নয়।
কেন বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যায়?
প্রশ্ন হলো মিয়ানমারের একটি রাজ্যের (রাখাইন/আরাকান) স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য সংগ্রামরত এই গোষ্ঠী কেন প্রায়ই বাংলাদেশি জেলেদের ট্রলারসহ ধরে নিয় যায় আবার ছেড়েও দেয়? অনুসন্ধান বলছে, আরাকান আর্মি যেহেতু বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বেশি সক্রিয়, তাই কক্সবাজার তথা ওই এলাকার বাজার থেকে তাদের বেঁচে থাকার বিভিন্ন রসদ, বিশেষ করে খাদ্য ও ওষুধ সংগ্রহ করা সহজ। ফলে যখনই আরাকান আর্মির খাদ্য ও রসদ ফুরিয়ে যায় এবং কোনো কারণে খাদ্য ও রসদ জোগাড় করতে পারে না অথবা ব্যাহত হয়,তখনই তারা অস্ত্রের মুখে বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যায় এবং মোবাইল ফোনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযাগ করে আরেকটি ট্রলারে তাদের চাহিদামতো রসদ পাঠাতে বলে। তারা রসদ পেয়ে গেলে জেলেদের ছেড়ে দেয়। এটা অনেকটা মুক্তিপণের মতো। তবে শোনা যায়, যেসব খাদ্য ও রসদ তারা দাবি করে, সেগুলো সংগ্রহের বিনিময়ে তারা টাকাও দিয়ে দেয়। উপরন্তু তারা বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে গেলেও তাদের নির্যাতন করে না। শোনা যায়, আরাকান আর্মির নেটওয়ার্ক খুবই শক্তিশালী। ফলে তারা নিজেদের রসদ নিজেরাই সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু নানা কারণে পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে তারা এই ধরনের অপহরণের ঘটনা ঘটায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করায় আরাকান আর্মি নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যের জানান দিতে অনেক সময় জেলেদের ধরে নিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ এটি তাদের একটি কৌশলগত পদক্ষেপও হতে পারে।
অনেক সময় ভুলবশত আটকের ঘটনাও ঘটে বলে শোনা যায়। অর্থাৎ সীমান্তে সুনির্দিষ্ট চিহ্নিত সীমানার অভাবে জেলেরা ভুল করে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে পড়লে আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়।
রোহিঙ্গা সংকট ও আরাকান আর্মি
বাংলাদেশের জন্য আরাকান আর্মির চেয়েও বড় উদ্বেগের নাম রোহিঙ্গা। সাম্প্রতিক বছরে আসা এবং আগে থেকে অবস্থান করা— সব মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান এ মুহূর্তে বাংলাদেশে অবস্থান করছে— যাদের অধিকাংশই বসবাস করছে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে। কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়েছে ভাসানচরে।
এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে পুরো কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে, সেটি কোনোদিন পূরণ করা যাবে কি না সন্দেহ। অর্থাৎ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ নিজেই এখন ‘ভিকটিম’। প্রশ্ন হলো, যে আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আরাকান আর্মি লড়াই করছে, তারা যদি সত্যিই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে লড়াইতে জয়ী হয়ে স্বায়ত্তশাসন আদায় করতে পারে তখন কি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে?
গত জানুয়ারিতে বিবিসির একটি খবরে বলা হয়, আরাকান আর্মি বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা দখল করে নিয়েছে। অঞ্চলটির নাম পালেতোয়া, যেটি মিয়ানমারের চিন রাজ্যে অবস্থিত। এই জায়গাটির বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব যত বাড়বে এই অঞ্চলের ভূরাজনীতি তত বেশি জটিল হবে। কারণ তাদের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একরকম স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন। রাখাইন অঞ্চলে জান্তা সরকারের কর্তৃত্ব দুর্বল করে আরাকান আর্মির প্রভাব বাড়তে থাকলে সেটি রোহিঙ্গা সংকটের জন্য ‘শাঁখের করাত’ হতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।
সাধারণত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের মধ্য থেকে আরাকান আর্মির সদস্য নিয়োগ করা হয়। ফলে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের সংবেদনশীলতা নেই বলে শোনা যায়। এমনকি তারা ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না। রাখাইন অঞ্চলের যে মংডু ও রথিডং থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, সেসব এলাকায় আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মাঝে মধ্যেই সংঘাত হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন তথা নিজ ভূমি রাখাইনে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় আরাকান আর্মি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে বা তাদেরকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে গেলে মিয়ানমার সরকার সেটিকে কীভাবে দেখবে— সেটিও বড় প্রশ্ন।
মিয়ানমার সরকার যে বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেবে না— সেটি তারা এরই মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখন একটি অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি তৃতীয় কোনো এক বা একাধিক দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে রাজি না হয় বা আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া এবং রাখাইনে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা না যায়, তাহলে এই ‘দেশহীন’ বিপুল জনগোষ্ঠীর বোঝা হয়তো বাংলাদেশকেই বইতে হবে।
তবে এও ঠিক যে, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের দুটি পথ হচ্ছে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মি— দুই পক্ষের জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেন্ট মার্টিনের অবস্থানের কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগরের অধিকাংশ এলাকাই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে। কাজেই ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্যকে অনেকটাই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে রাখাইনে যদি আরাকান আর্মির শত ভাগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বড় ধরনের দরকষাকাষির সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে অনেকে মনে করেন।
যদিও সাম্প্রতিক খবর বলছে, রাখাইনে দীর্ঘদিন নানাভাবে বিভক্ত সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। গত ৮ নভেম্বর সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠিগুলোর একটি গোপন বৈঠক হয়েছে। এতে বিবদমান আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও ), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ ) এবং আরও চারটি ইসলামি গোষ্ঠীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে।
অনেক সময় এরকম কথাও শোনা গেছে যে, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের নির্মম শিকার রোহিঙ্গারা এবার আরাকান আর্মিরও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এরইমধ্যে মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি।
রোহিঙ্গারা মনে করে, মংডু শহরটি রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও চেতনার প্রতীক। সুলতানি আমলে আরব বণিকদের আগমনের মাধ্যমে এই শহরে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এখন এই শহর আরাকান আর্মির দখলের মুখে, যা রোহিঙ্গা অস্তিত্বের জন্য এক ভয়ানক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং রাখাইনে আরাকান আর্মি পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে নাকি সংকট আরো বাড়বে,তা এখনই বলা মুশকিল।