সেই ‘জয় বাংলা’র পরবর্তী ইতিহাস অন্যরকম। ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া এবং এর জাতীয়করণের ধারাবাহিকতায় এখন এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, আপামর মানুষ ‘জয় বাংলা’র পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে গেছে। অথচ এই স্লোগানটি সাত কোটি মানুষকে একই সূতোয় গেঁথেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরে এখন এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে কে ‘জয় বাংলা’র পক্ষে আর কে বিপক্ষে—তা নিয়ে তর্ক হয়। এই যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, এর দায় কে নেবে?
কেন সাম্প্রতিক বিতর্ক
প্রসঙ্গত, ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা চেয়ে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বশির আহমেদের করা রিট আবেদনের শুনানি শেষে উচ্চ আদালত ২০২০ সালে এর পক্ষে রায় দিয়েছিলেন এবং ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা। এরপর ওই বছরের ২ মার্চ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
উচ্চ আদালত যে স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করেছিলেন, সেটি স্থগিত করলেন সর্বোচ্চ আদালত। প্রশ্ন হলো, একটি স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার কী প্রয়োজন ছিল এবং যদি ঘোষণা করা হয়েই থাকে, তাহলে সেটি বাতিল করারই বা কী দরকার? একটি স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান করার জন্য আদালতের শরণাপন্নই বা হতে হলো কেন? এটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই করা যেতো। শুধু একটি স্লোগান নয়, বরং জাতীয় জীবনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশেই করতে পারে, সেরকম অনেক বিষয় নিয়েই হয় সরকার আদালতে গেছে কিংবা সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে তৃতীয় কাউকে দিয়ে রিট করানো হয়েছে। অর্থাৎ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সুবিধা নিয়েছে।
সরকার তথা নির্বাহী বিভাগ এবং সরকারি দল যে বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, সেটি ১৯৭২ সালেই টের পেয়েছিলেন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে উত্থাপিত সংবিধান বিলের ওপর তিনি যে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমতসূচক বক্তব্য) দিয়েছিলেন, সেখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা সম্পর্কিত বিধানে সংশোধনী এনে বলেছিলেন, আইনজীবী হিসেবে ১০ বছর বা তার বেশি প্র্যাকটিস আছে, এমন কাউকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত হবে না। কেননা এর মাধ্যমে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের সম্ভাবনা থাকে, যার ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মৌলিকত্ব নিশ্চিতভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে যাদের রাজনৈতিক যোগসূত্র আছে, যারা সব সময় ব্যক্তিগত সুবিধার বিবেচনায় পরিচালিত, যারা তোষামোদি ভালোভাবেই রপ্ত করেছে এবং যারা জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় খুব কমই পরিচালিত হয়– এমন ব্যক্তিরাই এই ধরনের নিয়োগ পেয়ে থাকেন। তিনি চাকরিরত বিচারকদের মধ্য থেকে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের বিচার বিভাগে কী পরিমাণ দলীয়করণ হয়েছে, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ যদিও বলছে যে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ না করেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারবেন রাষ্ট্রপতি— কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কেননা প্রধান বিচার বিচারপতি এবং উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ যেহেতু অনেক বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়, ফলে এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতি এককভাবে নিজে নেন না। নিতে পারেন না। বস্তুত এটিও প্রধানমন্ত্রীরই সিদ্ধান্ত— যা গৃহীত হয় রাষ্ট্রপতির নামে। আর এ কারণেই বিচার বিভাগকে স্বাধীন বলা হলেও রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই সরকার বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায়। যে কারণে বিচার বিভাগের জন্য একটি আলাদা সচিবালয় স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের এবং মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে গত ২৭ অক্টোবর বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।
স্লোগান মূলত মিছিলের ভাষা। আন্দোলনের সময় প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ব্যানার ও দেওয়ালে লেখার কবিতা। গানের সঙ্গে স্লোগানের তফাৎ হলো, গানের একাধিক ছত্র থাকে। সাধারণত প্রতি দুই লাইনের শেষে অন্ত্যমিল থাকে। কিন্তু স্লোগান হয় ছোট। দুটি বাক্যে স্লোগান হতে পারে। তখন সেই স্লোগানের শেষেও অন্ত্যমিল থাকে। যেমন ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। আবার দুটি শব্দেও স্লোগান হয়। যেমন ‘জয় বাংলা’ ।
স্লোগান কখনো উদ্ভূত হয় তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে— কখনো বা সুচিন্তিত উপায়ে। জনতার মিছিল থেকে উচ্চারিত হয় স্লোগান— তার কোনোটি লাভ করে জনপ্রিয়তা, আবার কোনোটি বা হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। জনপ্রিয় স্লোগানটি প্রবহমান থাকে যুগের পর যুগ জনমানুষের কণ্ঠে— ক্রমে তা হয়ে ওঠে ইতিহাসের অংশ। স্লোগানের বিষয় ও ভাষা বিশ্লেষণ করলে বিশেষ সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায়। বস্তুত স্লোগানের ভাষার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা। গণমানুষের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ের অন্যতম উপায় স্লোগান। সে সূত্রে আন্দোলন ও স্লোগান শব্দদ্বয় অঙ্গাঙ্গিভাবে একাত্ম। (বিশ্বজিৎ ঘোষ, কালের কণ্ঠ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।
১৯৬৮-৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টিতে স্লোগানের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে সৃষ্ট স্লোগানসমূহ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে— এবং এভাবে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব জাগরণ। এ সময়ের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্লোগান হচ্ছে— ‘তোমার দফা আমার দফা, এগারো দফা এগারো দফা’, ‘এগারো দফার ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোল’, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’, ‘জয় জয় হবে জয়, বাংলার হবে জয়’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ ইত্যাদি। ছাত্রদের মিছিলে মিছিলে উচ্চারিত জনপ্রিয় স্লোগান ছিল— ‘আইয়ুব-মোনেম ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই’। এ সময় গোপন বামপন্থীদের মুখে উচ্চারিত হতো ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর, জনগণতন্ত্র কায়েম কর’।
ইতিহাস বলছে, ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আফতাবউদ্দিন আহমদ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি প্রথম উচ্চারণ করেন। সভা চলাকালীন সবাইকে আকস্মিকভাবে চমকে দিয়ে চিৎকার করে তিনি ‘জয় বাংলা’ বলতে থাকেন। তার সঙ্গে আরও সাত-আাটজন কর্মী সমস্বরে এই স্লোগান দেন (আমি সিরাজুল আলম খান, একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য, মাওলা ব্রাদার্স/২০১৮, পৃ. ১০৯)।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে এর তিন মাস পরে, ৪ জানুয়ারি ১৯৭০। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এদিন সকালে রমনা বটমূলে আলোচনা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। সভার সভাপতি মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী এবং প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খান প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার পরে এই প্রথম জনসম্মুখে শেখ মুজিব। মঞ্চে উপবিষ্ট বঙ্গবন্ধুর পেছনে দেবদারু পাতায় ছাওয়া ব্যানারে হলুদ গাঁদা ফুল দিয়ে লেখা দুটি শব্দ: ‘জয় বাংলা’। এটি অতি দ্রুত সমাবেশে উপস্থিত জনতার মাঝ্যে ছড়িয়ে যায়। আলোচনা শেষে ছাত্রলীগ ‘জয় বাংলা’ লেখা ওই ব্যানারটি নিয়ে র্যালি বের করে যা শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। পরদিন সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার পাশাপাশি ‘জয় বাংলা’ ব্যানারটির কথাও উল্লেখ করা হয়।
এর কয়েকদিন পরেই ১১ জানুয়ারি পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায়ও এই স্লোগানটি ব্যবহৃত হয়। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান জনপ্রিয় হতে থাকে। ছাত্রলীগের সিরাজপন্থী কর্মীরা একে অপরকে সম্ভাষণ জানাতে শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সত্তুরের ৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচনের সময় এ স্লোগানের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। ৭ জুন রেসকোর্স মাঠে আওয়ামী লীগ একটা জনসভা করে। ওই সভায় শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি দেন। বক্তৃতার শেষে তিনি ‘জয় সিন্ধু’, ‘জয় পাঞ্জাব’, ‘জয় বেলুচিস্তান’, ‘জয় সীমান্ত প্রদেশ’, ‘জয় পাকিস্তান’ উচ্চারণ করে তারপর বললেন ‘জয় বাংলা’। এর আগে ‘জিয়ে সিন্ধ’ স্লোগানটি দিয়ে সিন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতা জি এম সৈয়দ পাকিস্তানি শাসকদের কোপানলে পড়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ওই সময় ‘জয় বাংলা’র পাল্টা হিসেবে ‘জয় এগারো দফা’ ও ‘জয় সর্বহারা’ স্লোগান দিলেও ‘জয় বাংলা’র জোয়ারে সব ভেসে যায়। (মহিউদ্দিন আহমদ, জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা/২০১৪, পৃ. ২৭)।
মনিরুল ইসলাম লিখেছেন, আওয়ামী লীগের এই জনসভাকে কেন্দ্র করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিরোধিতা কিছুটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই বিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে জনসভার মঞ্চের সামনে লাল রঙে ‘জয় বাংলা’ লেখা হার্ডবোর্ড ঝুলানো নিয়ে। প্রথমে এর সমর্থকেরা সামনের দিকে মঞ্চের মাথায় এটা ঝুলিয়ে দেন, কিন্তু দুপুরের দিকে কিছু নেতার সহযোগিতায় তা নামিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্মীদের মাঝে শুরু হয় ব্যাপক বচসা। এই স্লোগানের সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতি জনসভার মঞ্চের সামনে বিরাট এক বৃত্তের সৃষ্টি করে। শোনা যায় বিষয়টি শেখ মুজিবের কাছে উত্থাপিত হলে তিনি ব্যাপক কর্মীদের পক্ষে মত দেন। জনসভার শুরুতে মঞ্চের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে ‘জয় বাংলা’। একটি স্লোগানকে নিয়ে বিতর্ক ও জয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের সাথে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পল্টনের এই জনসভার পর সারাদেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি বাঙালির আত্মচেতনার বহিঃপ্রকাশের প্রধান বাহন হিসাবে উঠে আসে। (মনিরুল ইসলাম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র, জ্যা পাবলিকেশন্স/২০১৩, পৃ. ১০৭)।
চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ
মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আগে স্বাধিকার আন্দোলনের ‘জয় বাংলা’ ছাড়া আরও অনেক স্লোগান ছিল। কিন্তু ‘জয় বাংলা’ সেসব স্লোগানকে ছাপিয়ে গেলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটি মূলত আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগানে পরিণত হয়। যেহেতু দেশের সকল দল এই স্লোগান দেয় না এবং আওয়ামী লীগও ‘জয় বাংলা’কে তাদের দলীয় স্লোগানে পরিণত করেছিল, সে কারণেই এটিকে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। কেননা কোনো একটি বিষয়কে জাতীয় বা সর্বজনীন ঘোষণা করতে হলে সেখানে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি।
তৎকালীন সরকার যদিও আদালতের রায়ের আলোকে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করেছিল, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক ঐকমত্য গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করেনি। যে কারণে তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে এ নিয়ে তেমন কোনো বিরোধিতা বা সমালোচনা না হলেও ৫ অগাস্টের পটপরিবর্তনের পরে বিষয়টি আলোচনায় আসে।
মুশকিল হলো ১৯৭১ তথা মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ যে ন্যারেটিভ বা বয়ান দিয়েছে, সেই বয়ানটিও সর্বজনীনন নয়। অর্থাৎ সকল দলের, অন্তত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল হিসেবে পরিচিত দলগুলোর মধ্যেও সে ব্যাপারে ঐকমত্য ছিল না। আওয়ামী লীগ যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাস নির্মাণের চেষ্টা করেছে, সেটিও হিতে বিপরীত হয়েছে। অথচ দলমত নির্বিশেষে অন্তত এই একটি ইস্যুতে একটি জাতীয় ঐক্য থাকার প্রয়োজন ছিল।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে। মূলত সেই চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষোভ থেকেই আওয়ামী লীগের পতনের পরে ‘ক্রিয়ার সমান প্রতিক্রিয়া’র তত্ত্ব অনুযায়ী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিরুদ্ধে অনেকেই বলছেন এবং এটিকে বাতিলের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
‘জয় বাংলা’ নিয়ে বিতর্কের প্রধান কারণ হলো আওয়ামী লীগ এই স্লোগানকে দলীয় স্লোগানে পরিণত করেছিল। যে স্লোগানটি মুক্তিকামী বাঙালির অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল, সেই স্লোগানটি কেন স্বাধীন বাংলাদেশে সকল দেশপ্রেমিক দল ব্যবহার করল না, অর্থাৎ অন্য সকল দলীয় স্লোগানের পাশাপাশি প্রতিটি দল কেন ‘জয় বাংলা’কে তাদের অভিন্ন স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করলো না বা করতে পারল না; অর্থাৎ ‘জয় বাংলা’ কেন শুধুই আওয়ামী লীগের স্লোগান হয়ে থাকল— সেটি বিরাট প্রশ্ন। কেন ‘জয় বাংলা’র বিপরীতে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলা হতো বা এখনও হয়, সেটিও তর্কের বিষয় এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথা জাতীয় গৌরবের বিষয়গুলোতেও যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই, ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান বানিয়ে সেটিকে চাপিয়ে দেওয়া; ‘জয় বাংলা’র নামে অনেক অপরাধ জায়েজ করা এবং তার বিপরীতে এই স্লোগানকে বিতর্কিত করা তার বড় উদাহরণ। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে ‘জয় বাংলা’ সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল তথা জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, সেই স্লোগানটি নিয়ে এখন পুরো জাতি দ্বিধাবিভক্ত!
‘জয় বাংলা’ ফ্যাসিবাদের স্লোগান?
গত ৪ নভেম্বর গণমাধ্যমের একটি খবরের শিরোনাম: ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় বাধ্যতামূলক অবসরে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন। খবরে বলা হয়, গত ২৪ অক্টোবর বাগেরহাট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল আহসানের উপস্থিতিতে বক্তব্য দেন সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দীন আহমেদ। বক্তব্যের শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন তিনি। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সিভিল সার্জনের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। এরপর প্রথমে তাকে ওএসডি করা হয় এবং পরদিনই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠনো হয়। প্রশ্ন হলো, একজন সরকারি কর্মচারীকে কেন একটি অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ বলে বক্তৃতা শেষ করতে হবে? এর কোনো প্রয়োজন ছিল? এটি করলেই কেন তাকে শাস্তি পেতে হবে?
এর দুই মাস আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পেছনে মেট্রোরেলের স্প্যামে লেখা ‘জয় বাংলা বলে আগে বাড়ো’ লেখাটি মুছে দেন ৬ জন শিক্ষার্থী। তাদের একজন এস. এম. এহসান উল্লাহ (ধ্রুব) বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পেছনে মেট্রোরেলে ফ্যাসিবাদের দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ লেখা ছিল। স্বৈরাচার তার অস্তিত্ব বিভিন্নভাবে মানুষের মনস্তত্ত্বে ঢুকিয়ে দিতে চায়। তারই প্রতীক হিসেবে ক্যাম্পাসের সব থেকে দৃশ্যমান স্থানে ছিল এই লেখা। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচারের সকল সিম্বলিক নিদর্শনগুলোকে মুছে ফেলতে চাই। যেন স্বৈরাচার কোনোভাবেই পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। (ঢাকা পোস্ট, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
এই শিক্ষার্থীর বক্তব্য খুব স্পষ্ট যে, তিনি বা তারা ‘জয় বাংলা’কে ফ্যাসিবাদের দলীয় স্লোগান বলে মনে করছেন। অথচ এই ‘জয় বাংলা’ই ১৯৭১ সালে এই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে সেই ‘জয় বাংলা’কে বলা হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদের দলীয় স্লোগান’!
কী আসে যায়?
হাইকোর্ট যখন ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করল এবং সেই রায়ের আলোকে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করল, তারপরেও এটি সত্যিকারার্থে জাতীয় স্লোগান হয়ে উঠতে পারেনি। কেননা এখানে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল না। অর্থাৎ এই রায় ও প্রজ্ঞাপনের পরেও আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া শুরু করেনি। একইভাবে আপিল বিভাগ ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান নয় বলে যে আদেশ দিলেন, তাতেও এটি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে না। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ঠিকই এই স্লোগান দেবে। অন্য কোনো দলও যদি এই স্লোগান দিতে চায়, তাতেও কোনো আইনি বাধা নেই। কেননা এই স্লোগানের কোনো কপিরাইট নেই। কোনো নির্দলীয় লোকও যদি ‘জয় বাংলা’ বলে রাস্তায় চিৎকার করেন, তাতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই অধিকার নেই যে তাকে শুধুমাত্র ‘জয় বাংলা’ বলার কারণে ধরে নিয়ে যাবে।
সুতরাং ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পরে এর মহিমা যেমন বাড়েনি তেমনি একে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণার রায় সর্বোচ্চ আদালত যে স্থগিত করলেন, তাতেও এই স্লোগানের কোনো অমর্যাদা হয়েছে বলে মনে হয় না। কেননা, ‘জয় বাংলা’কে যারা বাংলাদেশ, ১৯৭১ ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটি স্লোগান মনে করেন এবং দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এই স্লোগানকে ভালোবাসেন, তাদের মন থেকে ‘জয় বাংলা’ মুছে ফেলা যাবে না।
পরিশেষে, ‘জয় বাংলা’র মতো একটি স্লোগানকে দলীয় স্লোগানে পরিণত করে সেটিকে আবার জাতীয় স্লোগান বানিয়ে আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, একইভাবে এখন আওয়ামী বিরোধিতার নামে এই স্লোগানটিকে বিতর্কিত করা আরেক ধরনের খারাপ রাজনীতি। এই ধরনের রাজনীতি শুধুমাত্র মানুষে মানুষের বিভেদ বাড়ায়। দেশকে পিছিয়ে দেয়। কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও সংস্কারের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।