‘জানি না ঈশ্বর কে বা—জানি শুধু ভুখা ভগবান
দিনগত পাপক্ষয় ক’রে পাব ত্রাণ
তারপর একদিন নিমতলা ঘাটে
কিংবা কাশি মিত্রের তল্লাটে
পড়ে রব।’
জীবনানন্দের এই কবিতাটি রূপসী বাংলা পর্বের। জীবদ্দশায় এটি প্রকাশিত হয়নি। রূপসী বাংলা খাতায় লেখা ছিল। প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর ঠিক ৩০ বছর পরে ১৯৮৪ সালে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৪৩ বছর পরে। যেহেতু এটি রূপসী বাংলার খাতায় লিখিত, অতএব ধরে নেয়া সঙ্গত যে, কবিতাটি তিরিশের দশকে লেখা। অর্থাৎ তখনও রবীন্দ্রনাথ জীবিত। কলকাতা শহরের হুগলি নদীর তীরে নিমতলা ঘাটে তখনও রবীন্দ্রনাথকে সমাহিত করা হয়নি।
এই কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কী সম্পর্ক—সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ২০২৪ সালের তেসরা নভেম্বর বাংলা ট্রিবিউনের একটি খবরে চোখ বুলানো যাক। ‘কলকাতায় ভাঙছে গঙ্গা! বিপন্ন রবীন্দ্রনাথের সমাধি’। খবরে বলা হয়, কলকাতায় গঙ্গা নদীতে ভাঙন শুরু হয়েছে। গঙ্গার প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে নিমতলা ঘাটের একাংশ। কাছেই রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাধিক্ষেত্র। বিপন্ন সেই অংশটাও। সেই সঙ্গে বাগবাজার, কুমোরটুলির কাছেও গঙ্গার ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে।
এর আগে ওই বছরের ২০ অক্টোবর ইটিভি ভারতের একটি খবরে বলা হয়, উত্তর কলকাতার ব্যস্ততম নিমতলা ঘাট সুরক্ষিত নয়। গঙ্গার জলের তোড়ে প্রতিদিন ভাঙছে এই ঘাট। তৈরি হয়েছে মৃত্যু-ফাঁদ! দিনের পর দিন কাটলেও সরানোর কোনো নামগন্ধ নেই। শেষমেষ প্রাণহানি বা অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নিমতলা ঘাটকে ‘বিপজ্জনক’ তকমা দিল কলকাতা পৌরসভা। একেবারে ঘাটের মাঝে লোহার কাঠামো দিয়ে ঘিরে সেখানে বড় নীল রঙের ব্যানারে লেখা বিপজ্জনক! ঝুঁকি এড়াতে আপাতত ঘাটের ওই বিরাট অংশে বন্ধ থাকছে স্নান থেকে বিসর্জন। ধীরে ধীরে ভাঙছিল সিঁড়ি। বর্তমানে এখন এমন অবস্থা, যেখানে স্নান করতে নামলে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বিপদ! পায়ের তলায় একাংশে নেই মাটি। কংক্রিটের সিঁড়ি ভেঙে বেশ কিছু জায়গায় লোহার রড বেরিয়ে পড়েছে।
প্রসঙ্গত, নিমতলা মহাশ্মশান হল কলকাতার বিডন স্ট্রিট এলাকায় অবস্থিত একটি শ্মশানঘাট। ১৮২৭ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। ১৮৯১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দাহকার্য এখানে সম্পন্ন হয়। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও এই শ্মশানঘাটে দাহ করা হয়। তার সমাধিমন্দির এই শ্মশানের পাশেই অবস্থিত। বিশিষ্ট সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও এই শ্মশানে দাহ করা হয়। ২০১০ সালে ভারত সরকার এই শ্মশানঘাটের উন্নয়নের জন্য ১৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঘোষণা করে। এই প্রকল্পে শ্মশান ও শ্মশানঘাট সংলগ্ন রবীন্দ্রনাথের সমাধিমন্দিরটির শোভাবর্ধন করা হয়।
জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় নিমতলা ঘাটের কথা লিখলেন তিরিশের দশকে। একচল্লিশে রবীন্দ্রনাথকে সমাহিত করা হয় এখানে। জীবনানন্দ লিখেছিলেন নিজের কথা। কিন্তু এখানে তার সমাধি হয়নি। তার সমাধি হয়েছে এই নিমতলা থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে কলকাতা শহরের কালিঘাটের কাছে কেওড়াতলা শ্মশানে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ১৩ বছর পরে ১৯৫৪ সালে।
রবীন্দ্রনাথে সমাধি
জীবনানন্দ নিজের মৃত্যুর কথা লিখে গিয়েছিলেন মৃত্যুর ১৬ বছর আগে লেখা ‘ফুটপাথে’ কবিতায়।
‘কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে—
ফুটপাথ ফুটপাথে—
কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো
এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তের এদের
বিষাক্ত স্পর্শ অনুভব করে হাঁটছি আমি।’
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর সান্ধ্যকালীন হাঁটা শেষে কলকাতা শহরের ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাসায় ফেরার পথে বাসার কাছেই রাসবিহারী মোড়ে ট্রামের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন এবং অদূরেই শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকার পরে ২২ অক্টোবর রাতে মারা যান। প্রশ্ন হলো, ট্রামের বিষাক্ত স্পর্শ অনুভব করার কথা তিনি কী করে আগেভাগেই জানলেন?
এই দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার ঠিক আগের দিন ১৩ অক্টোবর কলকাতা রেডিওতে তিনি পড়লেন জীবনের শেষ কবিতাটি। শিরোনাম ‘মহাজিজ্ঞাসা’।
‘শূন্যকে শূন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে শেষে
কোথায় সে চলে গেল তবে।
কিছু শীত কিছু বায়ু আবছা কিছু আলোর আঘাতে
ক্ষয় পেয়ে চারিদিকে শূন্যের হাতে
নীল নিখিলের কেন্দ্রভার
দান করে অন্তহীন শূন্যতাময় রূপ বুঝি;
ইতিহাস অবিরল শূন্যের গ্রাস।’
শূন্যকে শূন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে যে চলে যেতে হবে, সেই কথাটি মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেই কী করে বলে দিলেন?
জীবনানন্দের হেমন্তপ্রীতির কথা সর্বজনজ্ঞাত। অনেক কবিতায় তিনি লিখেছেন যে হেমন্তের ঝরে যাচ্ছেন। মানে মরে যাচ্ছেন। তা-ই হয়েছে। হেমন্তের রাতেই মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কোথায় সমাধি হবে সেটি বলে যেতে পারেননি। বলেছেন নিমতলা ঘাট অথবা কালিমিত্রের তল্লাট।
জীবনানন্দের রবীন্দ্রপ্রীতির কথাও সবার জানা। যাকে উদ্দেশ করে জীবনানন্দ লিখেছিলেন:
‘তারপর তুমি এলে
এ পৃথিবী সলের মতন
তোমার প্রতীক্ষা করে বসেছিল।’
‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামেই তিনি কবিতা লিখেছিলেন ছয়টি। প্রবন্ধও লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি। সমসাময়িক কিংবা অগ্রজ কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কোনো কবির এমন পরিবেশন শুধু বাংলা নয়, সম্ভবত বিশ্ব সাহিত্যেই বিরল।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় পড়ালেখা ও কর্মসূত্রে জীবনানন্দ দাশ কলতা শহরে থেকেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু কখনো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেননি। বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে ১৯৩৭ সালের ৫ মার্চ রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে জীবনানন্দ লিখেছিলেন: ‘অনেকবার দেখেছি আপনাকে। তারপর ভিড়ের ভিতরে হারিয়ে গেছি। আমার নিজের জীবনের তুচ্ছতা ও আপনার বিরাট প্রদীপ্তি সব সময়ই মাঝখানে কেমন একটা ব্যবধান রেখে গেছে—আমি তা লঙ্ঘন করতে পারিনি।’
তার মানে সমীহ ও শ্রদ্ধার কারণেই রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি হননি তিনি। এর একটি বড় কারণ জীবনানন্দের লাজুক ও আত্মমুখীন স্বভাব। তিনি যেমন ভিড় এড়িয়ে চলতেন, তেমনি যেচে কারো সাথে আলাপেও যেতেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার যে সমীহসূচক শ্রদ্ধা ভালোবাসা ছিল, তাতে তিনি তার সাথে সাক্ষাতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তও ছিলেন। কিংবা মনে মনে হয়তো চেয়েছিলেন দেখা করবেন, কিন্তু নানা কারণেই হয়তো সেটি আর হয়ে ওঠেনি। তিনি নিজেই ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে গেছেন। যদি এই দুই কিংবদন্তির সাক্ষাৎ হতো, তাহলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেটি নিশ্চয়ই একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকতো এবং তাদের মধ্যে কী ধরনের কথাবার্তা হতো, তা আন্দাজ করা কঠিন।
রবীন্দ্রনাথের গান জীবনানন্দ কী ভীষণ পছন্দ করতেন তার দুটি উদাহরণ দেয়া যাক। বিয়ের প্রথম রাতে নবপরিণীতা লাবণ্যকে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে’ গানটি গাইতে অনুরোধ করেছিলেন। লাবণ্য জানাচ্ছেন, অনেকদিন পরে তিনি হাসতে হাসতে জীবনানন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ফুলশয্যার রাতেই তিনি এই গানটি কেন শুনতে চেয়েছিলেন? তখন জীবনানন্দ হেসে উত্তর দিলেন, এই লাইন দুটির অর্থ বলো তো? ‘আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া, তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া’। লাবণ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। জীবনানন্দ বললেন, জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এগান গাওয়া উচিত এবং শোনাও উচিত।
মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় জীবনানন্দ একবার রবীন্দ্রসংগীত শুনতে চেয়েছিলেন। আনিসুল হক ও জাফর আহমদ রাশেদকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ জানান, জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে ছোটভাই অশোকানন্দের বাসায় তার মরদেহ ঘিরে নারীরা ব্রাহ্মমতে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন। তার মানে জীবনের ওপারেও রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্গে ছিলেন। এমন সমীহ করা মানুষটিকে সমাহিত করা হলো তাঁর কবিতার নিমতলা ঘাটে।
এজাজ মাহমুদ লিখছেন, জোড়াবাগান চৌরাস্তা পেরিয়ে নিমতলামুখী সড়কে ঢোকার পর বেবিট্যাক্সির পাশ ঘেঁষে সাইরেনের কর্কশ আর্তনাদে পার হয় ফুলে সাজানো শবযবাহী গাড়ি—একটার পর একটা, জীবনের শেষযাত্রার পথে। ফিরে গেলাম ইতিহাসে, বাইশে শ্রাবণ, বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভার মহাপ্রস্থানের দিনটিতে, ৭ আগস্ট ১৯৪১ (বাইশে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)। ঠাকুরবাড়ি থেকে নিমতলা শ্মশানের দিকে রবিঠাকুরের শেষযাত্রা। শহরের নানা জায়গা ঘুরে এ পথেই নিমতলা মহাশ্মশানে গিয়েছিল কবিগুরুর শববহর, লাখো জনতার মিছিল ছিল পেছনে। ভক্ত-অনুরাগীর কাঁধের ওপর ভেসেছিলেন গুরুদেব—ফুলবৃষ্টি আর চোখের জলে। সোনালি বুটি দেওয়া চাদরে মোড়ানো কাঠের পালঙ্কে শোয়া শেষ সাজে বিশ্বকবি। (প্রথম আলো, ০৬ আগস্ট ২০২৩)।
ভারতীয় চিত্রশল্পী ও লেখক রানী চন্দ তাঁর ‘গুরুদেব’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘…পরনে সাদা বেনারসি জোড়-কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি। গলার নিচ থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো পাট কড়া চাদর। কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা। দুপাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল, রজনীগন্ধা। বুকের ওপরে রাখা হাতে একটি পদ্মকোরক। রাজবেশে রাজা ঘুমাচ্ছেন রাজশয্যায়…’।
জীবনানন্দের মরদেহ
জীবনানন্দের যেমন মৃত্যু হয়েছিল তাঁর প্রিয় ঋতু হেমন্তে। রবীন্দ্রনাথও পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যান তাঁর প্রিয় বর্ষায়। তাঁর শেষকৃত্যের যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় তা মোটামুটি এরকম। বেলা তিনটায় বের হয় শবযাত্রা। রাত আটটার পর নিমতলা শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মুখাগ্নি করেন কবির মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। লাখো মানুষের ভিড়ের চাপে শ্মশানে পৌঁছতেই পারেননি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পথেই আটকে ছিলেন। সুবীরেন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন নদীপথে। সে সময় নিমতলার চারপাশে ছিল লোকে লোকারণ্য—ঘাটের সীমানা ধরে রেলওয়ে ভ্যান, মোটরগাড়ি, পেছনের বড় বড় গাছ, দূরের বাড়ির ছাদ, নদীর পাড়ে সারি সারি নৌকায় মানুষ আর মানুষ, আবেগ-উন্মাদনা-বিষাদ বিদায় জানায় প্রিয় মরণবিজয়ী কবিকে। সবচেয়ে নির্মম ছিল, সংগ্রহে রাখতে কবির মরদেহ থেকে চুল ও দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
কেওড়াতলা শ্মশান, কলকাতা
কলকাতা শহরের পর্যটন স্পটগুলোর তালিকায় নিমতলা ঘাট নেই। কিন্তু রবীন্দ্রঅনুরাগীরা ঠিকই পুরোনো কলকাতার গলিঘুপচি মাড়িয়ে এখানে চলে আসেন এই আশায় যে, এখানেও রবীন্দ্রনাথ আছেন ‘হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।’