কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশের ৫৫ বছরের জীবনের (১৮৯৯-১৯৫৪) উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কিছু আগে তিনি পাকাপাকিভাবে জন্মস্থান বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেই ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কলকাতার ল্যান্সডাউন রোড (বর্তমান নাম শরৎ বসু রোড), রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, হ্যারিসন রোড (বর্তমান নাম মহাত্মা গান্ধী রোড), সিটি কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমানে ইউনিভার্সিটি), কলকাতা ইউনিভার্সিটি, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটসহ এই শহরের অনেক স্থাপনা, সড়ক ও অলিগলিতে জীবনানন্দের শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে। সেরকম কয়েকটি কম আলোচিত স্থাপনা নিয়ে এই আয়োজন।
ভেঙে ফেলা হয়েছে ঐতিহাসিক সিনেট হল
মৃত্যুর নয় মাস আগে ১৯৫৪ সালের ২৮ ও ২৯শে জানুয়ারি (বৃহস্পতি ও শুক্রবার) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে অনুষ্ঠিত কবি-সম্মেলনে জীবনানন্দ দাশ ‘বনলতা সেন’ ও ‘সুচেতনা’সহ আরো তিন-চারিটি কবিতা পাঠ করেন। এই অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা সিগনেট প্রেস – যাদের ঠিকানা ছিল ১০/২ এলগিন রোড, কলকাতা। যে এলগিন রোডে অবস্থিত শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে জীবনানন্দ শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। সিনেট হলের এই কবি-সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন নীহাররঞ্জন রায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও দিলীপকুমার গুপ্ত; যুগ্ম-সম্পাদক আলোক সরকার ও পূর্ণেন্দুবিকাশ ভট্টাচার্য। জীবনানন্দ দাশ কবিতা পড়েন সম্মেলনের প্রথম দিন অর্থাৎ ২৮শে জানুয়ারি, সবার শেষে। জীবনানন্দকে ওই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি বিবেচনায় সবার শেষে কবিতা পড়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, ঐতিহাসিক সিনেট হল ১৯৬০ সালে ভেঙে ফেলা হয়। এখন সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী ভবন। কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিন্ময় গুহ জানান, মূলত জায়গা সংকটের কারণেই ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়।
১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও প্রশাসনিক ভবন কলকাতা শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস, যা মূলত প্রশাসনিক ভবন এবং কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের জন্য বিখ্যাত। বিজ্ঞান বিভাগগুলোর বেশিরভাগই অবস্থিত রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। এছাড়া সাউথ ক্যাম্পাস, আলিপুর ক্যাম্পাস ইত্যাদি স্থানেও কিছু কিছু বিভাগ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মূলত শহরের বিভিন্ন এলাকায় এই আলাদা আলাদা স্থাপনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা আরো বিস্তৃত হয়েছে। তবে সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের একীকরণের জন্য অনেক বেশি জায়গার প্রয়োজন দেখা দেয় এবং কলেজ স্ট্রিটের তিনটি ভবন তখন যথেষ্ট ছিল না। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, পুরো বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি বালিগঞ্জে স্থানান্তরিত হবে। এজন্য তারকনাথ পালিত বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশাল জমিও দান করেছিলেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। এ-সময় সিনেট হলের ছাদ মেরামতের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে – এমন অজুহাতে অনেকেই ভবনটি ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের প্রাক্কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষপঞ্জিতে যে ২১৬টি অধিভুক্ত কলেজের তালিকা প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে ২৭টি কলেজ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে। জীবনানন্দের স্মৃতিবিজড়িত বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ তার অন্যতম। বাগেরহাট কলেজে ১৯২৯ সালে এবং ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।
সিনেট হল ভাঙার সঙ্গে একটা অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় জীবনানন্দের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের কর্মস্থল বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের। জীবনানন্দ দাশ যে পুরনো ভবনে পড়াতেন, অর্থাৎ তাঁর সময়কালে যে-ভবনে ইংরেজি বিভাগ ছিল, সেই ভবনটিও ১৯৯১ সালে ভেঙে ফেলা হয়েছিল ওই একই অজুহাতে যে, এটার ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ তখন পুরো ভবনটি ভেঙে আগের নকশা ও রং ঠিক রেখে একটা নতুন ভবন তৈরি করে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হল এবং বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের শতবর্ষী ভবন ভেঙে ফেলার পেছনে স্থানাভাব কিংবা ভবনের জরাজীর্ণতার বাইরেও নতুন ভবন নির্মাণের ঠিকাদারি ব্যবসাও যে বড় ভূমিকা রেখেছে, তা বুঝতে গবেষণার প্রয়োজন হয় না।
সিনেট হলের এই কবি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী কবিদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর মতে, এই সম্মেলনটি বাংলা কবিতায় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। এর আগে কবিদের এত বড় সমাবেশের কোনো বিবরণ তিনি পাননি এবং পরেও এত বড় সম্মেলন আর দেখেননি। আত্মজীবনীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তখনও রবীন্দ্র সদন হয়নি। সিনেট হলটিই কলকাতার সর্ববৃহৎ সভাকক্ষ, তার সম্মুখভাগ ক্ল্যাসিকাল গাম্ভীর্যমণ্ডিত, কোনো মূর্খের দল কিছুদিন পরেই সেটি ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অত বড় হলঘরটি ভর্তি করে শ্রোতারা দুদিন ধরে কবিতা পাঠ শুনেছে। সে যেন আধুনিকতার সমর্থকদেরই মিলন স্থান। সেখানেই জীবনানন্দ দাশের স্বকণ্ঠে কবিতাপাঠ প্রথম ও শেষবার শুনেছি।’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অর্ধেক জীবন, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০২, পৃ ১৪৩)। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানাভাবের কারণে ঐতিহাসিক সিনেট হল ভেঙে ফেলার পেছনে কর্তৃপক্ষের যত যুক্তিই থাকুক না কেন, ওই ঘটনাটি যে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের মনে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল, তা সুনীলের এই উক্তিতেই স্পষ্ট।
প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রাচীনতম। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর (১৮৫৬-১৮৬২) শাসনামলে ১৮৫৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। যে-বিশ্ববিদ্যালয় আইনের (১৮৫৭ সালের ২নং আইন) বলে এটি প্রতিষ্ঠিত তার মুখবন্ধে বলা হয়, মহারানীর সকল শ্রেণি ও ধর্মের প্রজাদের নিয়মিত ও উদার শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা এবং একই সঙ্গে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় পরীক্ষার মাধ্যমে সকল ব্যক্তির দক্ষতা নিরূপণ করাই হবে এ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য। এ সকল লোককে তাদের সাফল্যের প্রমাণস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি প্রদান করা হবে।
মৃত্যুর বছর অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে কবি-সম্মেলনে কবিতা পাঠ করাই শুধু নয়, বরং জীবনানন্দ নিজেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি এই বিশ্ববিদ্যলয়ের অধিভুক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এম.এ পাশ করলেও ইংরেজির পাশাপাশি তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগেও ভর্তি হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে থাকা। কারণ তখন আইনের শিক্ষার্থীরা হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে থাকার সুযোগ পেতেন। কিন্তু জীবনানন্দ আইন পড়া শেষ করেননি।
প্রভাতকুমার দাস (জীবনানন্দ দাশ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১৩, পৃ ২১) জানাচ্ছেন, ‘সম্ভবত তার (জীবনানন্দ) মতো লাজুক প্রকৃতির ছাত্র আইন পড়তে চেয়েছিলেন কেবল এই ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ পাওয়ার ভরসায়।’ অক্সফোর্ড মিশনের ছাত্রাবাস থেকে কেন তাকে হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে আসতে হলো তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। এই হোস্টেলে তার বাল্যসহপাঠী হরিজীবন থাকতেন। ফলে অক্সফোর্ড মিশন ছেড়ে এখানে আসতে চাওয়ার পেছনে এই কারণটি ছিল কি না তা পরিষ্কার নয়। তবে হতে পারে এই যে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন সে-ক্যাম্পাসেই থাকতে চেয়েছিলেন পথের দূরত্ব কমাতে।
অধ্যাপক চিন্ময় গুহ বলেছেন, আলাদা করে এখানে জীবনানন্দের কোনো স্মৃতি বা তার স্মৃতিতে কোনো আবক্ষ মূর্তি, ছবি কিংবা কোনো ফলক নেই। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং পরবর্তীকালে পৃথিবীবিখ্যাত হয়েছেন, এরকম মানুষের সংখ্যা অগণিত। ফলে আলাদা করে জীবনানন্দকে এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে পুরনো ভবনের কয়েকটি বিশাল ক্লাসরুম ঘুরিয়ে দেখিয়ে তিনি বলেন, হয়তো এসব কক্ষেই জীবনানন্দ ক্লাস করেছেন। আর যে হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে তিনি থাকতেন, সেটির নাম এখনো হার্ডিঞ্জ থাকলেও এটি এখন আর আবাসিক ভবন নয়, বরং এখানে এখন ক্লাস হয়।
মহাজাতি সদন : কেন বিস্মিত হয়েছিলেন কবি?
মৃত্যুর আগের বছর ১৯৫৩ সালে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনের পুরস্কার পান জীবনানন্দ দাশ। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৩৬০ বঙ্গাব্দের ২রা জ্যৈষ্ঠ কলকাতা শহরের মহাজাতি সদনে এই অনুষ্ঠান হয়। অতুলচন্দ্র গুপ্তের (১৮৮৪-১৯৬১) হাত থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন। প্রায় দুই হাজার দর্শকের উপস্থিতি দেখে জীবনানন্দ আশ্চর্য হয়েছিলেন। কারণ তাঁর ধারণা ছিল, খুব বেশি লোক তাঁর কবিতা পড়েন না।
কলকাতার ‘নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন’ তখন রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব পালন করে বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। তারা কয়েক বছর ধরে এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটিকে ১৩৬০ বঙ্গাব্দের জন্য মনোনীত করা হয়। পুরস্কারের নগদ মূল্য একশ টাকা। এই পুরস্কারপ্রাপ্তিতে তিনি খুশি হলেও চার বছর আগে প্রকাশিত তাঁর নবতম গ্রন্থ সাতটি তারার তিমিরকে বাদ দিয়ে বনলতা সেনকে পুরস্কৃত করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। সুরজিৎ দাশগুপ্তকে বলেছিলেন, ‘এ তো কবিকেও না, কবিতাকেও না, পাবলিকেশনকেই পুরস্কার দেওয়া।’ পুরস্কার গ্রহণের যে-ছবিটি এখন পাওয়া যায়, সেখানে জীবনানন্দের ভগ্নস্বাস্থ্য স্পষ্ট। অর্থাৎ ডায়াবেটিসে যে কাহিল হয়ে গিয়েছিলেন, সেটি খুব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই ছবিতে।
প্রসঙ্গত, কলকাতা শহরের মহাত্মা গান্ধী রোড মেট্রো স্টেশনের পাশে অবস্থিত মহাজাতি সদন। এর নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৩৯ সালের ১৯শে আগস্ট সুভাষচন্দ্র, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মহাজাতি সদনের মূল ভবনটি চারতলা। মাঝখানে ১৩০০ আসনবিশিষ্ট একটি প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। প্রেক্ষাগৃহের চারপাশে কয়েকটি হলে স্থায়ী প্রদর্শনীর ব্যবস্থা আছে। সদনের চারতলায় আছে ১০০ আসনবিশিষ্ট একটি সভাকক্ষ। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মহাজাতি সদনের আধুনিকীকরণ সম্পন্ন করা হয়।
গারস্টিন প্লেসের সেই ‘ভূতের বাড়ি’
দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার আগের দিন ১৯৫৪ সালের ১৩ই অক্টোবর রাতে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের পুরনো বাড়িতে যে কবি-সম্মেলন হয়, সেখানে ‘মহাজিজ্ঞাসা’ নামে একটি কবিতা পড়েন জীবনানন্দ দাশ। কবিতাটি ওই বছর আনন্দবাজার পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়। এই কবি সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায় (বনফুল), সজনীকান্ত দাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্যও উপস্থিত ছিলেন।
বেতার কেন্দ্রের এই অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে জীবনানন্দ খুব অনিশ্চিত, চিন্তিত এবং কিছুটা অস্থির ছিলেন। ‘প্রেমেন ও সুধীনবাবু আসবেন। তাঁকেও যেতে হবে। সুতরাং কড়ে আঙ্গুলের কাছে ছেঁড়া কাপড়ের জুতোর এক পাটির শোচনীয় অবস্থা সামাল দেন কী করে? শেষ পর্যন্ত গড়িয়াহাটার বাজার থেকে সুচরিতা এক জোড়া সাত নম্বর বাটার পাম্প শু কিনে দিয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ নিশ্চিন্ত ও প্রসন্ন করলেন। জীবনানন্দ মোটামুটি আত্মস্থ হয়ে কবি-সম্মেলনে গেলেন।’ (জীবনানন্দ দাশ, প্রভাতকুমার দাস, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ ১৫৯)।
মধ্য কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের কাছে হেয়ার স্ট্রিট থেকে বের হওয়া ছোট্ট গলি গারস্টিন প্লেস। রাস্তার ১ নম্বর বাড়িতে ছিল বেতারের পুরনো অফিস। ১৯২৬ সালে এসপ্লানেড অঞ্চলে টেম্পল চেম্বার্স বিল্ডিংসে বেতার সম্প্রচারের কেন্দ্র খোলে বিবিসি। পরে সেটি ওই বাড়িতে উঠে আসে। সেখানেই ১৯২৭ সালের ২৬শে আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ – যেটি পরে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’। ১৯৫৮ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও নাম পরিবর্তন করে ‘আকাশবাণী’ নামকরণের পরই ইডেনের পাশে আজকের ঠিকানায় সরে আসে। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই মার্চ ২০২৩)।
অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে জীবনানন্দ কবিতা পড়েছিলেন গারস্টিন প্লেসে অবস্থিত বেতারের পুরনো ভবনে। পরবর্তীকালে এই ভবনটি ‘ভূতের বাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। কেননা এই ভবনটি যেখানে নির্মাণ করা হয়, একসময় সেখানে কবরস্থান ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে মৃত অনেক সাহেবকে সমাহিত করা হয়। তাঁদের আত্মা নাকি এখানে ঘুরে বেড়ায়। অনেকে নাকি এখানে অশরীরী ছায়া দেখেছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ঐতিহাসিক নানা ঘটনার সাক্ষী এই ভবনটি ১৯৯৭ সালে ভেঙে ফেলা হয়।
জীবনানন্দ সভাঘর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা
১৯৯৯ সালে জীবনানন্দ দাশের জন্মশতবর্ষে কলকাতা শহরে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ভবনে উদ্বোধন হয়। জীবনানন্দ সভাঘর। এখানে ৭০ জনের মতো বসার ব্যবস্থা আছে। মূলত সেমিনারের জন্য এই হলরুমটি ব্যহার করা ও ভাড়া দেওয়া হয়।