বাদল রশীদ (১৯২৯—১৯৯৩)
প্রথমত আইনজীবী, দ্বিতীয়ত ভালো ইংরেজি জানতেন—সম্ভবত এই দুই কারণে সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন বাদল রশীদ। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের অধিকাংশই আইজীবী তথা আইনের ছাত্র হলেও বাদল রশীদই একমাত্র ব্যক্তি, গণপরিষদের কার্যবিধিতে যাঁর নামটি লেখা এভাবে: ‘বাদল রশীদ, বার-এট-ল’।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ তাঁর ১৯৭২ সালের ১৮ এপ্রিলের ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘বিকেল ৫টা থেকে খসড়া সংবিধান কমিটির বৈঠক শুরু হল। (Preamble) প্রস্তাবনা থেকে আলোচনা শুরু হল। ইংরেজিটা নিয়ে প্রথম ব্যারিস্টার বাদল রশীদ পড়লেন।’
একটু পেছনে ফেরা যাক। ষাটের দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাস ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক। নির্ধারিত সময়ে ঘটলো এক অঘটন। যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। হঠাৎ প্রধান অতিথির চেয়ারে বসে পড়েন এক বাঙালি ছাত্র। নাম বাদল রশীদ। তিনি তখন লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ছেন। আইয়ুব খান অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করেন। সঙ্গত কারণেই বাদল রশীদ তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়েন। ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফেরার পথে করাচি বিমানবন্দরে তাঁর কিছু কাগজপত্র জব্দ করা হয়। তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরলেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। কিছুদিন পালিয়েছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে ভাবলেন এভাবে বেশিদিন পালিয়ে থাকা সম্ভব নয়। ফলে আত্মসমর্পণ করেন এবং কারাগারে যান। জেলখানায় বসে পরিচয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তাঁর পরামর্শে রাজনীতিতে যোগ দেন।
এই ঘটনাটি বলেছেন বাদল রশীদের ভাগ্নে অধ্যাপক নওরোজ মোহাম্মদ সাঈদ। যদিও এই ঘটনার আগেই বাংলাদেশি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্রদের নিয়ে লন্ডনে ‘ব্যাক টু ভিলেজ’ নামে সংগঠন গড়ে তুলে আলোচনায় আসেন বাদল রশীদ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে হন জাতীয় পরিষদ সদস্য। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির এই সদস্য ছিলেন কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। গ্রাম, মাটি ও মানুষের টানে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাটিয়েছেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায়।
রাজধানীর ঝা চকচকে জীবন তাকে টানেনি। তিনি মিশে গিয়েছিলেন গ্রামের মানুষের সঙ্গে। সেখানেই শুরু করেন কৃষিবিপ্লব। লোকেরা তাঁকে ভালোবেসে বাদল ব্যারিস্টার, মাইঠো ব্যারিস্টার অথবা লুঙ্গিপরা ব্যারিস্টার বলে সম্বোধন করতো। কেউ ডাকতো ‘মিয়া ভাই’। শেষদিকে মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েন বাদল রশীদ। তাঁর স্নেহধন্য নজরুল জাহিদের (বর্তমানে জাতিসংঘে কর্মরত) ভাষায়: বাদল রশীদ ছিলেন তাঁর কাছে একটা ‘বিস্ময়ের প্যাকেজ’।
বর্ষণমুখর দিনে জন্ম বলে নাম বাদল
বাদল রশীদ ১৯২৯ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রুস্তম আলী বিশ্বাস ছিলেন কলকাতা আদালতের একজন দোভাষী (ইন্টারপ্রেটার)। মায়ের নাম মেহেরুন্নেছা।
বর্ষণমুখর দিনে জন্ম হওয়ায় মা-বাবা তাঁর নাম রাখেন বাদল। প্রাথমিকভাবে রামদিয়ার পৈতৃক নিবাসে এবং পরবর্তীকালে আলমডাঙ্গায় (বরষা বিলাস) বসবাস করতেন। তাঁর পুরো নাম ছিল আবু আহমেদ আফজালুর রশীদ। কিন্তু এফিডেভিট করে তিনি বাদল রশীদ হয়ে যান।
বাদল রশীদের পরীক্ষার সার্টিফিকেট
১৯৪৪ সালে জোড়াদহ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তখন স্কুলটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। ১৯৪৭ সালে সিটি কলেজ (কুষ্টিয়া শাখা) হতে আই.এ এবং ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ পাস করেন। এরপর আলমডাঙ্গা হাইস্কুলে তিনি অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে তিনি লন্ডনের লিংকনস-ইন এ ব্যারিস্টারি পড়তে যান। সেখানে তিনি তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ‘ব্যাক টু দ্য ভিলেজ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য ছিল, পড়াশোনা শেষ করে এই সংগঠনের সদস্যরা দেশে ফিরে গিয়ে গ্রামের মানুষের উন্নয়নে কাজ করবেন।
১৯৫৩ সালে তিনি গড়ে তোলেন ইস্ট পাকিস্তান এসোসিয়েশন। দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত তিনি এই সংগঠনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি ‘পূর্ব বাংলা’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করেন।
১৯৬৩ সালে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করে দেশে ফিরে ঢাকা বার কাউন্সিলে রেজিস্ট্রেশন করেন এবং আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তখন রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। তবে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় আইন পেশা ছেড়ে নিজ গ্রাম রামদিয়ায় ফিরে যান। পশ্চাৎপদ মানুষের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে নিজ গ্রামে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এলাকার ক্রীড়ামোদি ও শিশুদের জন্য বিদ্যালয় সংলগ্ন বড় একটি খেলার মাঠ তৈরি করেন। এছাড়া একটি বাজার, একটি পোস্ট অফিস, অগ্রণী ব্যাংক, সমাজ কল্যাণ অফিস, পরিবার পরিকল্পনা অফিস এবং আলমডাঙ্গা হতে রামদিয়া-কায়েতপাড়া পর্যন্ত বৈদ্যুতিক লাইন সম্প্রসারিত করেন। কর্দমাক্ত গ্রামীণ রাস্তাটির কাজ শেষ করেন।
বাদল রশীদ ১৯৬৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলায় অন্য আরও অনেক নেতার সঙ্গে ছয় দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে জাতীয় পরিষদের চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গা-দামুড়হুদা ও জীবননগর আসনে (কুষ্টিয়া-৪) আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। ওই নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে জাতীয় পরিষদ সদস্য (আসন ৪২) নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে কুষ্টিয়া-৪ আসনে মোট ভোটার ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ১০৬ জন। বাদল রশীদ পেয়েছিলেন ৯৯ হাজার ৭২৯ ভোট।
মুক্তিযুদ্ধ: বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার রানাঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে বাদল রশীদ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ইপিআর চতুর্থ উইংয়ের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী সপরিবারে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গায় ফিরে আসেন। ওইদিন বিকেলেই স্থানীয় এসোসিয়েশন হলে (পরবর্তীকালে শহীদ আলাউদ্দিন হল) স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং অফিসারদের জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। সেখানে আবু ওসমান চৌধুরীকে অধিনায়ক, ডা. আসহাব-উল হককে প্রধান উপদেষ্টা এবং ব্যারিস্টার বাদল রশীদ ও অ্যাডভোকেট ইউনুস আলীকে উপদেষ্টা করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ড গঠন করা হয়।
২৭ মার্চ সকাল ১১টার দিকে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর চতুর্থ হেডকোয়ার্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে বংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। চুয়াডাঙ্গার কয়েকজন কর্মকর্তাসহ ৩০-৪০ জন লোকের উপস্থিতিতে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে হলুদ মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। যদিও এর কিছুদিন আগে থেকেই চুয়াডাঙ্গার প্রতিবাদী মানুষেরা সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। একই দিন দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গনের উপদেষ্টা বাদল রশীদকে আওয়ামী লীগের দলীয় প্যাডে তাঁর পরিচয় উল্লেখ করে বহির্বিশ্বে প্রচার, যোগাযোগ ও সহযোগিতার প্রত্যাশায় ভারতে পাঠানো হয়। (রাজিব আহমেদ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: চুয়াডাঙ্গা জেলা, পৃষ্ঠা ৩)।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি এবং তহবিল সংগ্রহে নিরলস কাজ করেন বাদল রশীদ। তিনি ছিলেন প্রবাসী সরকারের পলিটিক্যাল লিয়াঁজো অফিসার এবং মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্তী তাজউদ্দীন আহমদের ব্যক্তিগত সহকারী।
রাজ কুমার রামেকোর ‘আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিচিতি’ বইতে লেখা হয়েছে, বাদল রশীদ অল ইন্ডিয়া ডক শ্রমিক ফেডারেশানের তৎকালীন সেক্রেটারি কূলকী নায়ারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে বিস্তারিত জানান। মিস্টার নায়ার অল ইন্ডিয়া ডক শ্রমিক ফেডারেশানের একটা সভা আহ্বান করেন এবং ব্যারিস্টার বাদল রশীদ সেই সভায় বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিহিত সম্পর্কে অল ইন্ডিয়া ডক শ্রমিকদের অবহিত করেন। অল ইন্ডিয়া ডক শ্রমিক ফেডারেশান নায়ারকে এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক ডক শ্রমিক ফেডারেশানের সাথে কথা বলার জন্য দায়িত্ব প্রদান করে, যার সদর দপ্তর ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মিস্টার নায়ার ছিলেন আন্তর্জাতিক ডক শ্রমিক ফেডারেশানের একজন সদস্য। তিনি আন্তর্জাতিক ডক শ্রমিক ফেডারেশানের মাধ্যমে আমেরিকান ডক শ্রমিক ফেডারেশানকে বাংলাদেশর যুদ্ধের বিষয়ে অবহিত করেন। ফলে মার্কিন ডক শ্রমিকরা পাকিস্তানি জাহাজে যুদ্ধের সরঞ্জাম বোঝাই করতে অস্বীকার করে। পরে মার্কিন সাধারণ জনগণ পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করতে নিক্সন সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। এরপর মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
বাদল রশীদ লন্ডন শহরে অবস্থিত তাঁর একমাত্র বাড়িটিও জনমত গঠনের কাজে ব্যবহার করতেন। লন্ডনের ‘বাংলাদেশ হাউজ’ বাড়িটি তিনি প্রবাসী সরকারকে দান করেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ওই বাড়িটি বাংলাদেশ দূতাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীদের সঙ্গে বাদল রশীদ। সামনে বসা, বাম থেকে চতুর্থ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণে সংগঠিত একটি বহুমুখী যুদ্ধ, জনযুদ্ধ। এখানে শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও বড় ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দলের নেতা হিসেবে বাদল রশীদ সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান করার জন্য ‘বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে মুম্বাইসহ ভারতের সকল বড় বড় শহরে অনুষ্ঠান করেন। তৎকালীন শান্তিনিকেতনের উপাচার্যের সহযোগিতায় আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার, সরদার আলাউদ্দিন, নমিতা ঘোষ, মকছেদ আলি শাহসহ ভারতের নামিদামী বাঙালি শিল্পীকে নিয়ে ৭৯ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে জমা দেন। এ সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীদের নিয়ে গঠন করা হয় বাংলা কালচারাল ট্রাস্ট। দলটি ভারতের বিভিন্ন স্থানে গান গেয়ে ১৭ লাখ টাকা, বস্ত্র ও ওষুধ সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের হাতে তুলে দেয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া নিয়েও জোরালো ভূমিকা রাখেন বাদল রশীদ। ভারতীয় মুসলমানদের জনমতকে বাংলাদেশর পক্ষে আনার জন্য তিনি দিল্লী জামে মসজিদের প্রধান ইমামের সাথে দেখা করেন। পরে তিনি ভারতের তৎকালীন প্রাধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথেও কথা বলেন। এ বিষয়ে বাদল রশীদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আরে বাপু, আমি তখন সদ্য লন্ডন ফেরত। ইংরেজি ভাষায় কথা বলা আমার জন্য সহজ ছিল। সেজন্য আমাকে জোর করে বলা হত বাদল ভাই, আপনি না গেলে হবে না।’ (রাজ কুমার রামেকো, আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিচিতি)।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত আলমডাঙ্গা উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকার ২০৬ নম্বরে আছেন বাদল রশীদ। তাঁর পরিচিতি নম্বর ০১১৮০০০১৪৪৪, বেসামরিক গেজেট ৭৮৯, লাল মুক্তিবার্তা ৪০৬০২০৩২৯।
সংবিধান প্রণয়ন থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের অধিকাংশই আইজীবী তথা আইনের ছাত্র হলেও বাদল রশীদই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর নামের সঙ্গে সব সময়ই বার এট ল ব্যবহার করা হতো। এমনকি গণপরিষদের কার্যবিধিতেও তাঁর নামটি লেখা হতো এভাবে: ‘বাদল রশীদ, বার-এট-ল’।
তবে তিনি যে মন্ত্রী হতে পারলেন না বা তাঁকে যে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য করা হলো না—এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিল না বাদল রশীদের। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আরে বাপু, আমি কলকাতার অফিসে কাজকাম করতাম। সেখানকার কাগজপত্র বোঝাই করে অন্যান্য কাজ শেষ করে দেরিতে এসেছিলাম। দেরিতে আসার জন্য দেখা গেল সব দপ্তর বণ্টন হয়ে গেছে। মন্ত্রিত্ব না পেলেও বঙ্গবন্ধু আমাকে কখনও দূরে সরতে দেননি। তিনি সব সময় বলতেন, বাদল ভাই, আপনে সব সময় আমার কাছে কাছে থাকবেন।’ (রাজ কুমার রামেকো, আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিচিতি)।
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাদল রশীদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন কুষ্টিয়া-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসনে ভোটার ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৬১২। বাদল রশীদ পেয়েছেন ৫৫ হাজার ৮০৫ ভোট।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তিনি কুষ্টিয়া-৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মালেক গ্রুপের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। এই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৬ জন। বাদল রশীদ পেয়েছিলেন ১৩ হাজার ৮৬ ভোট। এখানে বিজয়ী হন বিএনপির মিঞা মো. মনসুর আলী। তিনি পেয়েছিলেন ৩৮ হাজার ১৮৮ ভোট।
বাদল রশীদ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৫১৬। বাদল রশীদ পেয়েছিলেন ২৯ হাজার ৪২ ভোট। এখানে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী মকবুল হোসেন। তিনি পেয়েছিলেন ৩৪ হাজার ৮৭২ ভোট।
উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পরে বাদল রশীদের বিজয় মিছিল
এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পরে দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন এবং ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই বছর ৪৬০টির মধ্যে ৪২৬টি উপজেলায় নির্বাচন হয়। প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয় ১৯৮৫ সালে। তবে এই নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। দলীয় প্রতীকে ভোট না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯০ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ৩৭%, আওয়ামী লীগ ৩০%, জামায়াতে ইসলামী ৬%, বিএনপি ৫.৫%, বাকশাল ১.৭%, জাসদ (রব) ১.২% এবং ১০ শতাংশ উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন।
কৃষিঅন্তঃপ্রাণ ‘মাইঠো ব্যারিস্টার’
লন্ডনে পড়াশোনা করলেও রাজধানীর জীবন বাদল রশীদকে টানেনি। বিশেষ করে পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে তিনি আরও বেশি গ্রামমুখী হয়ে যান। ধীরে ধীরে মূলধারার রাজনীতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। গ্রামের সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। সেখানে কৃষিবিপ্লব শুরু করেন। একজন ব্যারিস্টার কাস্তে কোদাল নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন এবং পুরোদস্তুর কৃষক হয়ে উঠলেন। তিনি পরিত্যক্ত বা অব্যবহৃত জলাশয় পরিষ্কার করে সেখানে মাছ চাষ শুরু করলেন এবং গ্রামের মানুষদেরকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন।
তিনি পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে ওই সময়ের কৃষির সঙ্গে পরিচিত হন এবং সেই জ্ঞান নিজের দেশে, নিজের গ্রামে কাজে লাগানো শুরু করেন। তিনি দেখেছেন কীভাবে মাছ চাষ করতে হয়। কীভাবে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাঁর বাড়ির কাছেই ছিল বিশাল বাঁওড়। সেই জলাশয়ে শুরু করলেন মাছ চাষ। সেই মাছ যখন বড় হলো তা দেখে গ্রামের লোকেরা তো বটেই, আশেপাশের মানুষও দারুণভাবে উজ্জীবিত হলো এবং অনেকেই তখন তাদের আশেপাশের জলাভূমিতে এভাবে মাছ চাষ শুরু করলো। সেই সঙ্গে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো এবং কৃষকের পরিশ্রম কমানোর জন্য কৃষির যান্ত্রিকীকরণ শুরু করলেন বাদল রশীদ। ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদ শুরু করলেন। সেচের জন্য শ্যালো মেশিন কিনলেন। যেটা তখন গ্রামের মানুষ ভাবতেই পারতো না।
অধ্যাপক নওরোজ মোহাম্মদ সাঈদ মনে করেন, এখন সারা দেশে যে গবাদি পশুর ফার্মের ছড়াছড়ি, এটির যাত্রা শুরু আসলে বাদল রশীদের হাত ধরেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাদল রশীদ তাঁর গ্রামে গবাদি পশু ও হাঁস মুরগির খামার গড়ে তোলেন—যার পরবর্তীতে দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে। আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ভেটেরেনারি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও বাদল রশীদের অবদান অনস্বীকার্য।
অধ্যাপক সাঈদ বলছেন, বাদল রশীদ এই কাজগুলো যতটা না নিজের জন্য, তার চেয়ে বেশি করেছেন গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য। কেননা তিনি চাইলে আইনজীবী হিসেবেই পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন এবং তাতে প্রচুর টাকা-পয়সা উপার্জন করে অনায়াসে একটি স্বচ্ছল জীবনযাপন করে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি গ্রামকে ভালোবেসে, গ্রামের মানুষকে ভালোবেসে কৃষির সঙ্গেই বসবাস করলেন। ইউরোপে পড়াশোনা করলেও এবং পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরলেও তাঁর জীবনাচরণ ছিল আবহমান গ্রামবাংলার অতি সাধারণ মানুষের মতো।
নজরুল জাহিদ জানান, আলমডাঙ্গা শহরে বাদল রশীদের একটা কুঁড়ে ঘরে কয়েকটি বেঞ্চ পাতা ছিল। এটি ‘বাদল ব্যারিস্টারের চাতাল’ নামে পরিচিত ছিল। এখান থেকে তাঁর গ্রামের বাড়ি রামদিয়ার দূরত্ব ১৫ কিলোমিটারের মতো। একটা ‘ফিফটি মোটর সাইকেল’ চালিয়ে যাওয়া-আসা করতেন। প্রতিদিন বিকালে গ্রাম থেকে আলমডাঙ্গা শহরে এসে ওই চাতালে বসতেন। আড্ডা দিতেন। তাঁকে ঘিরে একটা মজমা বসতো। এমনকি রিকশাচালকদেরও অনেকে রিকশা থামিয়ে সেখানে বসে যেতেন বাদল রশীদের কথা শোনার জন্য।
নজরুল জাহিদের কাছে শোনা আরেকটি গল্প। ১৯৮১ সালের কথা। ছাত্রলীগের সম্মেলন। একটা ফিফটি সিসি হোন্ডা বাইকে (নীল সাদা রং ছিলো, তখনই ভগ্নদশা) সম্মেলনে এলেন বাদল রশীদ। তখনো পাকাপাকি আলমডাঙ্গায় থাকা শুরু করেননি। পুরো সম্মেলনজুড়ে তাঁকে ঘিরে একটা সমীহ। সবাই খুব মানছেন তাঁকে। কিন্তু কেউই ভয় পাচ্ছেন না। নজরুল জাহিদ বলছেন, ‘তিনি একইসাথে সাধারণ এবং অসাধারণ। কথাবার্তায় চোশত ভাব নেই। একেবারে আলমডাঙ্গার উচ্চারণ। অবাক হলাম। মানুষটা এমন ‘‘গ্রাম্য’’ হলো কেমন করে!’ নজরুল জাহিদের ভাষায়: ‘বাদল রশীদের এক হাত ছিল বুকে, আরেক হাত মাটিতে।’ তিনি গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ভালোবাসতেন এবং লালন করতেন। বিশেষ করে লালনের গানের প্রসারে তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন।
উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পরে আলমডাঙ্গার ইঙ্গিত সাহিত্য পর্ষেদর পক্ষ থেকে দেওয়া সংবর্ধনায় বাদল রশীদ
বাদল রশীদের ছেলে তাপস রশীদ বলেন, ‘বাবার মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামের উন্নয়ন। তিনি ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে এসে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আইন পেশায় নিয়োজিত হলেও সেখানে স্থায়ী হননি। খুবই সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। থাকতেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি।
১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠায় বাদল রশীদ দারুণ ভূমিকা পালন করেন। কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। ‘সাপ্তাহিক কৃষক’ এবং ‘কৃষক ও কৃষাণী’ নামে দুটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তখন বন্যা ও সেচমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ততা সমস্যা মোকাবেলায় বাঁধ নির্মাণ ইস্যুতেও কাজ করেন বাদল রশীদ। দেশে প্রথম তুলা চাষকে উন্নত করার পদ্ধতি নিয়েও কাজ করেছিলেন তিনি।
পরিবার, অসুস্থতা ও মৃত্যু
সস্ত্রীক বাদল রশীদ
ষাটের দশকের শেষদিকে বাদল রশীদ বিয়ে করেন শেরীফা রশীদকে। বাদল-শেরীফা দম্পতির চার সন্তান। বড় মেয়ে শম্পা রশীদ, মেজ মেয়ে শ্যামলী রশীদ, ছোট মেয়ে কাকলী রশীদ এবং ছেলে তাপস রশীদ। ১৯৯৩ সালে ১৭ জুন বাদল রশীদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এক আত্মীয় পার্শ্ববর্তী হরিণাকুন্ড থেকে একজন ডাক্তার নিয়ে আসেন। তিনি বাদল রশীদকে দেখে বলেন তাঁর বুকে পানি জমেছে। তিনি বাদল রশীদকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
ছেলে তাপস রশীদ বলেন, ‘আব্বা যেদিন অসুস্থ হলেন সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। আম্মা একটা মহিষের গাড়িতে করে রামদিয়া গ্রাম থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আলমডাঙ্গা শহরে নিয়ে যান। তারই নিজের বানানো রাস্তা। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সেদিন ওই রাস্তা দিয়েও খুব সহজে তাঁকে শহরে নিয়ে আসা যাচ্ছিল না। তাঁকে ঢাকায় নিতে দেরি হয়।’
বাদল রশীদের মেয়ে কাকলী রশীদ জানান, ২১ জুন তাঁর বাবাকে ঢাকায় এনে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ধরা পড়ছিল না। ওইদিনই তাঁকে রাজধানীর কলাবাগানে বেঙ্গল বেঙ্গল নার্সিং হোম নামে তাঁর এক আত্মীয়ের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুদিন পরে ২৩ জুন মারা যান।
কাকলী বলেন, ‘আব্বা বই ও পত্রিকা পড়তে ভালোবাসতেন। যেদিন মারা যান সেদিন সকালেও ছোট খালা এসে পত্রিকা দিয়ে গিয়েছিলেন। ২৩ তারিখরও পত্রিকা পড়েন। মৃত্যুর ২০ মিনিট আগে তাঁকে একটা ইঞ্জেকশন দেয়া হয়। তারপর একটা শব্দ করেন। আম্মা ডাক্তার ডাকলেন। কিন্তু আব্বা আর সাড়া দেননি।’ কাকলী জানান, বাদল রশীদ যেদিন মারা যান সেদিনও তুমুল বৃষ্টি ছিল। অর্ধাৎ বর্ষণমুখর দিনে জন্ম বলে বাবা মা যাঁর নাম রেখেছিলেন বাদল, সেরকম বর্ষণমুখর দিনেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাঁকে আলমাঙ্গা শহরের দারুস সালাম কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সূত্র: আমীন আল রশীদ, সংবিধান প্রণেতাগণ, শিলালিপি/২০২৪