মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করতে হলো কেন?

মেঘনা আলম

বড় ধরনের অপরাধ করতে পারেএমন সন্দেহ বা আশঙ্কা থেকে মামলা বা পরোয়ানা ছাড়া প্রশাসনিক আদেশে বা সিদ্ধান্তে তাকে আটক করার নামই হলো নিবর্তনমূলক আটক। অর্থাৎ তাকে কোনো একটি অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখা তথা নিবর্ত বা ক্ষান্ত অথবা বিরত রাখা। সেরকম একটি আইনের নাম বিশেষ ক্ষমতা আইনযে আইনে সম্প্রতি মডেল, অভিনয়শিল্পী ও মিস আর্থ বাংলাদেশ ২০২০ বিজয়ী মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছে।

১৯৭৪ সালে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এবং বিশেষ ধরনের অপরাধ দমনের জন্য তৈরি ওই বিশেষ আইনে ৫০ বছর পরে কেন একজন নারীকে আটক করতে হলোতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে গণঅভ্যুত্থানের মুখে গঠিত নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এরকম একটি বিতর্কিত আইনের প্রয়োগের ফলে সরকারও দারুণভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এরইমধ্যে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল স্বীকার করেছেন যে, মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও তাকে আটকের প্রক্রিয়াটি সঠিক ছিল না। উপরন্তু মেঘনা আলমকে আটকের সঙ্গে জড়িত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিককেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি মেঘনা আলমের আটকাদেশের বৈধতা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট রুলও জারি করেছেন।

কেন নিবর্তনমূলক আটক?

আইনের ভাষায় আটক সাধারণত দুই ধরনের। ১. শাস্তিমূলক আটক (Punitive Detention) এবং ২. নিবারণমূলক বা নিবর্তনমূলক আটক (Preventive Detention)। কোনো অপরাধ সংঘটন বা আইন লঙ্ঘনের পর যখন কোনো ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সেটিকে বলা হয় শাস্তিমূলক আটক। সাধারণত এ ধরনের আটকের আগে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা লাগে। অথবা ৫৪ ধারায়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে আটক করতে পারে। কিন্তু একজন ব্যক্তিকে আইন লঙ্ঘন বা অপরাধ করতে পারেনএমন আশঙ্কা বা ধারণা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করলে সেটিকে বলা হয় নিবারণমূলক বা নিবর্তনমূলক আটক।

শাস্তিমূলক আটকের ক্ষেত্রে আটকাদেশ দান করেন আদালত। পক্ষান্তরে নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষেত্রে আটকাদেশ দেয় নির্বাহী প্রশাসন। শাস্তিমূলক আটকের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণ করা হয়। কিন্তু নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষেত্রে আদালতের সামনে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করা বাধ্যতামূলক নয়। ১৯৭৪ সালে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ওই আইনটি করা হয়েছিল মূলত কালোবাজারি, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রবিরোধী বড় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত লোকদের ধরার জন্য। যদিও শুরু থেকেই আইনটি নিয়ে নানা বিতর্ক ওঠে।

খ্যাতিমান আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ লিখেছেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন যদিও সমাজবিরোধী তৎপরতা রোধের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিলো, তথাপি এর পেছনে ক্ষমতাসীন সরকারের একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও প্রচ্ছন্নভাবে সক্রিয় ছিলো। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও সংগঠনের অধিকার ইত্যাদিও এই আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা রাখা হয়। দেখা গেছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল বা তথাকথিত সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও এই আইন ব্যবহারের পর্যাপ্ত ক্ষেত্র উন্মুক্ত ছিলো, তথাপি কখনোই তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। কতিপয় অপরাধের জন্য গুলি করে প্রাণদণ্ড প্রদানের বিধান থাকলেও বাস্তবে একজনকেও ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য রক্ষীবাহিনী ও সময়ান্তরে সেনাহিনীকে কাজে লাগানো হলেও তাদের সমস্ত উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, কারণ বহুক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থকরা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আইনে আরোপিত শাস্তি কার্যকর করা যায়নি। প্রায়শই দেখা গেছে যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনুরোধেই সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে হয়েছে এবং রক্ষীবাহিনী সব সময়ই দলীয় ভূমিকা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগারদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে। (মওদুদ আহমদ, শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকাল, ইউপিএল/১৯৮৭, পৃ. ১৯৬)।

মেঘনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?

আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মেঘনা আলমকে

মেঘনা আলমকে আটকের বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ওঠে কারণ গত ৯ এপ্রিল রাতে তাকে আটকের আগে তিনি ফেসবুক লাইভে এসে অভিযোগ করেছিলেন যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তার ঘরের দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। যদিও তখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। গণমাধ্যমের খবর বলছে, পরদিন ঢাকার সিএমএম আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনে মডেল মেঘনা আলমকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

বলা হচ্ছে, সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের অনানুষ্ঠানিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা পুলিশ তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। যদিও ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা করার অভিযোগে মেঘনা আলমকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। গত ১২ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুলিশের এক বার্তায় বলা হয়, দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনা আলমকে সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। ডিএমপির এই পোস্টটি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও।

প্রশ্ন হলো, একজন নারী মডেল ও অভিনয়শিল্পীকে এই প্রক্রিয়ায় আটক করার প্রয়োজন ছিল কি না? যদি সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলাও থাকে, তারপরও তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো একটি বিতর্কিত আইনে আটক করার প্রয়োজন ছিল কি না? মেঘনা আলম সত্যিই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার মতো কাজ করেছেন না কি সৌদি আরবের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের একজন কূটনীতিক অভিযোগ করেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ অতি উৎসাহী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে আটক করলো?

সরকারি ভাষ্য দুরকম

আসিফ নজরুল, আইন উপদেষ্টা 

১৩ এপ্রিল সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, মডেল মেঘনার ব্যাপারে কিছু অভিযোগ আছে, সে বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে সবকিছু যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে তাকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া ঠিক হয়নি। যদিও এর দুদিন পরে ১৫ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক মডেল ও অভিনেত্রী মেঘনা আলমের সঙ্গে বেআইনি কিছু করা হয়নি। তিনি বলেন, এই একটা ক্ষেত্রেই আইনটা ব্যবহার হয়েছে, এমন না। এটা বেআইনি কাজ না। এখন যদি বলেন যে, নির্দিষ্ট এই ক্ষেত্রে কেন হয়েছে, এটা একটা ঘটনা।

মো. খোদা বখস চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী

প্রশ্ন হলো, আইন উপদেষ্টা যেখানে বলছেন যে, মেঘনাকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া সঠিক ছিল নাসেই একই বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী কী করে এর পক্ষে সাফাই গাইছেন? যে আইনটি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে বিতর্ক চলছে এবং খুব ব্যতিক্রম ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে আইনের প্রয়োগ করা হয়নি, সেই আইনে কেন একজন নারীকে গ্রেপ্তার করতে হলো? তাও শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার যখন ক্ষমতায় আছে? যদি মেঘনা আলমের সঙ্গে বেআইনি বা অনৈতিক কিছু করা না হয়ে থাকে, তাহলে ওই ঘটনায় কেন ডিবির প্রধানকে সরিয়ে দেয়া হলো?

অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণকারীদের মামলা ছাড়াই কিংবা গায়েবি মামলায় ধরে নিয়ে যেতো আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলো। উপরন্তু ওই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফাই গাইতেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সেই প্রবণতা থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না কেন, এটি বিরাট চিন্তার বিষয়।

পরিশেষে

সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মেঘনা আলমের কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা থাকলে তার মধ্য দিয়ে দুই সম্পর্ক নষ্ট কেন হবে কিংবা এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত  হবে কেনসেই প্রশ্নের সুরাহা করা জরুরি। একজন বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকের কোনো সমস্যা তৈরি হলে রাষ্ট্র কার পক্ষে দাঁড়াবে বা কাকে সুরক্ষা দেবেমেঘনা আলমের গ্রেপ্তারের পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রশ্নটিও অনেকে সামনে এনেছেন।

সুতরাং, মেঘনা আলমের পরিচয় যাই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সরকারের উচিত হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটি পরিষ্কার করে জানানো। কোনো একটি প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূত অভিযোগ করেছেন বলেই তাকে একটি বিতর্কিত আইনে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকার নড়েচড়ে বসবে নাএটি দেশের ভেতরে তো বটেই, দেশের বাইরেও কোনো ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে না।

প্রকাশ: বিডি আর্কাইভ, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top