জুলাই ঘোষণাপত্র ইস্যুতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে যেদিন (১৬ জানুয়ারি ২০২৫) ‘সর্বদলীয়’ বৈঠক হলো, সেদিন দুপুরের দিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের একটি খুদেবার্তা গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।
সেটি এরকম: ‘আজ ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, দুপুর ১ টা ২৯ মি. বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সাধারণ সম্পাদকের ফোনে নামবিহীন খুদেবার্তা পাঠিয়ে আগামীকাল বিকাল চার ঘটিকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে খসড়া ঘোষণাপত্র বিষয়ে আমাদের পর্যালোচনা উপস্থিত করতে বলা হয়। সাথে ঘোষণাপত্র পাঠানো হয়। আমরা জানতে পারি বৈঠকটি আগামীকালের নয়, আজ ১৬ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে। সার্বিক বিবেচনায়, খুদেবার্তায় আমরা আমন্ত্রণকারীকে জানিয়েছি, উল্লিখিত বিষয়ে পার্টিতে, আমাদের বাম জোটে, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শ করে এতো অল্প সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এসব কাজ সম্পন্ন করা বাস্তবসম্মত নয়। সার্বিক বিবেচনায় সিপিবি’র পক্ষে আজ ১৬ই জানুয়ারির বৈঠকে উপস্থিত থাকা সম্ভব হচ্ছে না।’
রুহিন হোসেন প্রিন্সের খুদেবার্তা
এদিন সকালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টিও বৈঠকে যোগ না দেয়ার কথা জানায়। লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান সাংবাদিকদের বলেন, ‘দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথের রাজনৈতিক দল। বুধবার রাত ৯টা ৫১ মিনিটের সময় একটা এসএমএস পাঠিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বিকাল চারটায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দাওয়াত দেওয়াকে আমরা অসম্মানজনক ও অসৌজন্যমূলক আচরণ মনে করি। তাই আজকের সভা বর্জন করার জন্য লেবার পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ এলডিপিও সম্ভবত এ কারণেই বৈঠকে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এই বৈঠকের সময় ছিল বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা। কিন্তু এতে বিএনপি অংশ নেবে কি না, সে বিষয়ে প্রায় ৩টা পর্যন্ত অনিশ্চয়তা ছিল। বিএনপির প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, বৈঠকে বিএনপি যোগ দেবে কি না, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে। সম্ভবত বিএনপিও বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রক্রিয়া, ভাষা এবং সময় স্বল্পতার কারণে প্রস্তুতির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে দোটানায় ছিল যে, তারা আদৌ এই বৈঠকে অংশ নেবে কি না। উল্লেখ্য, এদিন দলের মহাসচিবও ঢাকায় ছিলেন না। শেষ মুহূর্তে জানা যায়, দলের স্থায়ী স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বৈঠকে যাচ্ছেন।
শেষ পর্যন্ত বৈঠকে বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণতন্ত্র মঞ্চ, খেলাফত মজলিস ও গণঅধিকার পরিষদ (একাংশ), রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জেএসডি, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও জাতীয় গণফ্রন্টের প্রতিধিনিরা অংশ নেন। এর বাইরে জুলাই ঘোষণপত্র জারির ‘প্রধান স্টেকহোল্ডার’ জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বৈঠকে অংশ নেন।
ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দ, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫
বৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সব রাজনৈতিক দলকে একসাথে দেখলে তিনি সাহস পান। তবে জুলাই ঘোষণার বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেন তিনি নিজেই। বলেন, ‘কিছুদিন আগে ছাত্ররা এলো আমার কাছে। বললো তারা একটা ঘোষণাপত্র দিতে চায়। আমাকেও থাকতে হবে সেখানে। আমি বললাম কী ঘোষণা? তারা বললো…। আমি বললাম এটা হবে না। কারণ ৫ আগস্টের ঘটনা ঘটেছিল ঐক্যের মাধ্যমে। সুতরাং এটা সবাইকে নিয়েই করতে হবে। তোমরা যেভাবে বলছ এভাবে হবে না। আমার এই কথায় তারা খুশি হয়নি। তবে পরে মনে হলো যে তারাও বুঝতে পেরেছে।’
‘সর্বদলীয়’ বৈঠকে ড. ইউনূস, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫
বস্তুত ড. ইউনূস দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এটি উপলব্ধি করেছেন যে, যদি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের মতো করে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করে সেটি ঘোষণা করে দিতো, তাহলে এটি গ্রহণযোগ্য হতো না। সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এটি নিয়ে অনৈক্য তৈরি হতো—যা দেশের এই ক্রান্তিকালে একটি নতুন সংকটের জন্ম দিতো।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই বছরের ১০ এপ্রিল জারিকৃত ঘোষণাপত্রের আলোকে ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলিউশন’ বা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারির কর্মসূচি দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল ৩১ ডিসেম্বর বিকালে।
সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিলো, এই ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’ হবে ‘আগামীর বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র’। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে এর মাধ্যমে ‘নাৎসি বাহিনীর’ মতো ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করা হবে। একইসঙ্গে ১৯৭২ সালের ‘মুজিববাদী’ সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে।
জুলাই ঘোষণা নিয়ে প্রেস সচিবের ব্রিফিং
যে ঘোষণাপত্র এদিন পাঠ করা হবে বলে শোনা যাচ্ছিলো, তার একটি কপি দুদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায়। কিন্তু অনুষ্ঠানের ঠিক আগের রাতে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম শুরুতে এই কর্মসূচির সঙ্গে সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই এবং এটি একটি প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ (ব্যক্তিগত উদ্যোগ) বলে দাবি করলেও ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি সংবাদ ব্রিফিয়ে জানান, অন্তর্বর্তী সরকারই এরকম একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করবে—যেখানে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকবে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে একটি লিখিত বক্তব্যও দেয়া হয়, যেটি এরকম: ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে। আমরা আশা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।’
এরপর প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক ঘোষণা করেছিলেন যে ৩১ ডিসেম্বর বিকালের কর্মসূচি বহাল রয়েছে। কিন্তু মধ্যরাতে জানানো হলো যে, কর্মসূচি হবে। তবে সেখানে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে না। কর্মসূচির নাম দেয়া হয় ‘মার্চ ফর ইউনিটি’। অর্থাৎ ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’ কর্মসূচি পরিণত হয় ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিতে। এই কর্মসূচি থেকে সরকারকে জুলাই ঘোষণাপত্র জারির জন্য ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়।
মার্চ ফর ইউনিটি, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪
এরপর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জানান, সরকার এই ঘোষণাপত্র তৈরি করবে না। তবে ফ্যাসিলিটেট করবে। তারপরেও জানানো হয় যে, এই ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু সর্বদলীয় বৈঠকের নামে কী হয়েছে, তা এরইমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একজন উপদেষ্টার ফোন নম্বর থেকে (কেউ কেউ বললেছন অপরিচিত নম্বর) মেসেজ পাঠিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিশে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে অসম্মান করা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। সরকার এই ঘোষণপত্রের বিষয়ে কতটা সিরিয়াস বা তারা তাদের অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ‘চাপে’ এ বিষয়ে একটি মধ্যবর্তী অবস্থান নিয়েছে কি না; এই ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করা বা তাদের মতামত বিবেচনায় নেয়ার বিষয়টি স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা কি না—এসব প্রশ্নও জনমনে আছে।
তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, গত ১৬ জানুয়ারির ‘সর্বদলীয়’ বৈঠকে জুলাই ঘোষণা ইস্যুতে কি আদৌ কোনো রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে—যেখানে বারবার জোর দিচ্ছিলেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা? ঐকমত্য যে হয়নি তার প্রমাণ শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো একটি খুদেবার্তা। যেটি এরকম: ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় সংলাপের পরবর্তী কর্মপন্থা হিসাবে গণুভ্যুত্থানে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলসহ সকল অংশীজন থেকে অভিমত নেয়া হচ্ছে। আপনাদের সুচিন্তিত অভিমত চিঠি মারফত পাঠাতে পারেন- মাহফুজ আলম, উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় এ ঠিকানায়। আগামী ২৩শে জানুয়ারি পর্যন্ত চিঠি মারফত আপনাদের অভিমত জানাতে পারবেন। এ অভিমতগুলো পর্যালোচনা করে একটি সংশোধিত ও সর্বজনগ্রাহ্য ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জনগণের উপস্থিতিতে তা অনতিবিলম্বে ঘোষিত হবে।’
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো কী কী মতামত দিয়েছে, তার বিস্তারিত গণমাধ্যমে আসেনি। তবে বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য নেই। যত সময় লাগুক তা দিতে সম্মত সবাই। তবে অযথা কালক্ষেপণ যেন না হয়, সে বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে।’ এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নে সবার সঙ্গে আলোচনার জন্য একটি কমিটি গঠনেরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে এখনও যে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি, এমনকি এই ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মধ্যেও যে একটা টানাপোড়েন চলছে—তা স্পষ্ট। ফলে এই ঘোষণাপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বললেও অযৌক্তিক হবে না। বিশেষ করে, যদি শেষ পর্যন্ত সরকারের দিকনির্দেশনায় বা উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাষায় সরকার যদি এই কাজে ‘ফ্যাসিলিটেট’ করে, তারপরও যে ডকুমেন্টটি তৈরি হবে, সেটি সর্বজনগ্রাহ্য হবে কি না; সব দলের মতামত আমলে নিয়ে এটি তৈরি করা যাবে কি না; এর ভাষা কী হবে এবং সর্বোপরি এই ঘোষণাপত্র তৈরির মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার, দেশের রাজনীতি এবং দেশ ও জনগণের কী লাভ হবে—সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এরইমধ্যে ঘোষণাপত্রের যে খসড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেখানে সাতচল্লিশে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি, একাত্তরে জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাহাত্তরের সংবিধান স্বাধীনতার শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যাশার প্রতিফলনে ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তী শাসনামলেও রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে ব্যর্থতা ছিল। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়নি।
খসড়ায় বলা হয়েছে, ক্ষমতার সুষ্ঠু রদবদলের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে ষড়যন্ত্রমূলক ১/১১-এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র আধিপত্যের পথ সুগম হয়। শেখ হাসিনার শাসনামলের গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে। বিগত সরকারের আমলে গণবিরোধী একনায়কতান্ত্রিক, মানবাধিকার হরণকারী শক্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুনি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পরিচিত করে।
শেখ হাসিনার পরিবারের নেতৃত্বে উন্নয়নের নামে দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও বিদেশে টাকা পাচার সব সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে। এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র, শ্রমিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ গত ১৫ বছর নিরন্তর সংগ্রাম করে জেলজুলুম, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রের তল্পিবাহক আওয়ামী লীগ ন্যায়সংগত আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে বলেও ঘোষণাপত্রের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়।
শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলেও ‘বাহাত্তরের সংবিধান স্বাধীনতার শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যাশার প্রতিফলনে ব্যর্থ হয়েছিল’ বাক্যটির বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কেননা মু্ক্তিযুদ্ধে শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল। এর চরিত্র নষ্ট করা হয়েছে বা ধীরে ধীরে এই সংবিধানকে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে। সেটি বাহাত্তরের সংবিধানের সমস্যা নয়। সমস্যা রাজনৈতিক দলের।
আরেকটি বড় প্রশ্ন সামনে আসবে এই ঘোষণাপত্রের শিরোনাম নিয়ে। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘প্রক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলিউশন’ বা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র। কিন্তু বিএনপিসহ আরও একাধিক রাজনৈতিক দল, যারা জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিল, তারা এই অভ্যুত্থান বা আন্দোলনকে ‘বিপ্লব’ বলে মনে করে না। আর যদি এটা বিপ্লব না হয়, অর্থাৎ এটি যদি একটি বৃহ্ত্তর রাজনৈতিক আন্দোলন বা অভ্যুত্থান হয়, তাহলে এর কোনো ঘোষণাপত্র তৈরির যৌক্তিকতা নেই। বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, তাতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই ঘটনাকে যে বিপ্লব বলার সুযোগ নেই, সেটি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠজনরাও বলছেন। ফলে যদি এটিকে বিপ্লব প্রমাণ করা না যায় তাহলে এর প্রক্লেমেশন বা ঘোষণাপত্র তৈরির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে এবং এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য তৈরি হবে।
বাহাত্তরের মূল সংবিধানের প্রস্তাবনা
ফলে প্রশ্ন হলো, যদি শেষ পর্যন্ত একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করা সম্ভব হয়, তারপরও এটি নিতান্তই একটি ডকুমেন্ট হয়ে থাকবে, নাকি এর ওপর ভিত্তি করে আগামীর বাংলাদেশের গতিপথ নির্ধারিত হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, অন্তর্বর্তী সরকারের গত পাঁচ মাসে দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ রাষ্ট্রের নানা স্তরে যেরকম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তাতে এই মুহূর্তে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের মতো ইস্যুটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ বা এর প্রয়োজনীয়তা কী?
দেশের বিদ্যমান সংকট নিরসন, রাষ্ট্রীয় অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধ তথা চিরস্থায়ীভাবে এগুলো বন্ধের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত তথা রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরেই বরং সরকারের এখন বেশি মনযোগী হওয়া দরকার এবং সেই কাজে রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, জুলাই ঘোষণাপত্রের উদ্যোক্তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিরও এই কাজে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা উচিত।