
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যবৃন্দ (এখানে কয়েকজন অনুপস্থিত)
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান এবং কার্যকর হয় ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন কেবল ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস; বাংলাদেশের সংবিধানও তেমনি বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে কিছু অনুচ্ছেদ ধার করে তৈরি করা কোনো ডকুমেন্ট নয়। বরং এর প্রতিটি বাক্য, শব্দ, সেমিকোলন নিয়ে গণপরিষদে বিতর্ক হয়েছে।
প্রক্রিয়া শুরু ৩ জানুয়ারি ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে শপথ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানে ১৯৭০ সালের গণপরিষদ নির্বাচনের বিজয়ী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদেরকে নৌকা আকৃতির মঞ্চে বসিয়ে শপথবাক্য পাঠ করান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এই সভার মাধ্যমে এই বার্তাটি দেওয়ার চেষ্টা করা হয় যে, আওয়ামী লীগই জনগণের নির্বাচিত ও বৈধ একমাত্র প্রতিনিধি। প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগের ২৬৮ জন এবং জাতীয় পরিষদের ১৫১ জন (মোট ৪১৯ জন) সদস্য শপথ পাঠ করেন। তারা সর্বতোভাবে ৬ দফা এবং ১১ দফা কর্মসূচির প্রতি, জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা এবং উভয় কর্মসূচিকে শাসনতন্ত্রে প্রতিফলিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
বঙ্গবন্ধু এই সভায় ঘোষণা করেন, ৬ দফা ও ১১ দফা এখন আর কোনো দলের সম্পত্তি নয়। এটা জনগণের সম্পত্তি। ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতেই প্রস্তাবিত সংবিধান রচিত হবে। (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিন কাল, অনন্যা/২০০৩, পৃ. ১০১)।
সংবিধান তৈরির জন্য সাব কমিটি

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির জীবিত ৪ সদস্যের অন্যতম
এর কিছুদিন পর ১৬ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে পরিষদের বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে সংসদীয় দলের নেতা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপনেতা নির্বাচন করা হয়। এদিন নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংবিধান (পাকিস্তানের জন্য) রচনার জন্য আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল একটি সাব-কমিটি গঠন করে। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ছিলেন এই কমিটির একজন সদস্য। তিনি লিখেছেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের দ্বিতীয় দফা ও শেষ প্রচেষ্টা ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা। পহেলা মার্চ সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে রচনাকারী কমিটির পক্ষ থেকে খসড়া সংবিধান পেশ করা হয়। এই বৈঠকে পাঞ্জাবের মালিক সরফরাজসহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। আমার প্রণীত খসড়া সংবিধান কমিটির অনুমোদন লাভ করে। এ ব্যাপারে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সংসদীয় দলের ওপর ন্যস্ত করেন।’ (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কাগজ প্রকাশন/১৯৯১, পৃ. ১২)।
সংবিধানের ভিত্তি

মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম
১০ এপ্রিল ১৯৭১ ভারতের মাটিতে গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এক সপ্তাহ পরে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (ওই দিন থেকে ‘মুজিবনগর’) এই সরকারের শপথ গ্রহণের দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। আর এই ঘোষণাপত্রই ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ভিত্তি।
অস্থায়ী সংবিধান আদেশ
১১ জানুয়ারি ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরদিন ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করেন। এই আদেশে বলা হয় যে, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তার সমস্ত কার্য সম্পাদন করবেন।
কমিটি গঠনের আগেই সংবিধানের খসড়া
আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে উদ্ধৃত করে ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি সংবাদ সংস্থা এনার খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন হচ্ছে এবং এর চূড়ান্ত রূপ দিতে বেশি সময় লাগবে না। শাসনতন্ত্রে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হবে বলেও জানান আইনমন্ত্রী। (দৈনিক বাংলা, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭২)।
এর ১০ দিন পরে ২৯ জানুয়ারি ‘বিশ্বস্ত’ সূত্রের বরাত দিয়ে এনার খবরে বলা হয়, খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত। খসড়া শাসনতন্ত্রের মুখবন্ধে বলা হয়েছে : গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের মৌলনীতির ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে এই দেশকে গড়ে তোলা হবে। খসড়া শাসনতন্ত্রে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতি, প্রশাসনিক বিভাগ থেকে আইন বিভাগকে আলাদাকরণ, ব্যক্তিগত মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্যের নিশ্চয়তা বিধানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্ম পালনের অধিকার রক্ষারও নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। ড. কামালকে উদ্ধৃত করা খবরে বলা হয়, সংবিধান প্রণয়ন কমিটি প্রথমে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহক কমিটির কাছে এর খসড়া পেশ করবে এবং তাদের বিবেচনার পর তা গণপরিষদে পাঠানো হবে। (দৈনিক বাংলা, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২)।
বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ
১৯৭২ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ জারি করা হয়। এই আদেশ অনুসারে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিতদের নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠিত হয়, যাদের ওপর বাংলাদেশের সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটি
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের বৈঠক বসে এবং পরদিন ১১ এপ্রিল গঠিত হয় সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। কমিটির জন্য ৩৪ জন সদস্যের নাম প্রস্তাব করেন মুনসুর আলী, যেখানে বলা হয় ড. কামাল হোসেন এই কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। স্পিকার (মুহম্মদুল্লাহ) প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। ৩৪ সদস্যের এই কমিটিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, হাফেজ হাবিবুর রহমান, আব্দুল মুন্তাকীমে চৌধুরী, নুরুল ইসলাম চৌধুরীদের সঙ্গে একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতনি রাজিয়া বানু।
কমিটির বৈঠক

রাজিয়া বানু, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একমাত্র নারী সদস্য
সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। কমিটির বৈঠক বসে একাদিক্রমে ১৭ থেকে ২৯ এপ্রিল, ১০ থেকে ২৫ মে, ৩ থেকে ১০ জুন, ১০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর এবং ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর। মোট ৮৫ দিন। তৃতীয় দফার বৈঠকে অর্থাৎ ১০ জুন সংবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া অনুমোদিত হয়। পূর্ণাঙ্গ মানে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ। তারপরে বাকি রয়ে যায় ইংরেজি ভাষ্যের আইনগত দিক এবং বাংলা ভাষ্যের ভাষাগত দিকের উন্নতিসাধন। ইংরেজিতে সংবিধানের খসড়া তৈরি করেন ড. কামাল হোসেন। এটির বাংলা করে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে ড. আনিসুজ্জামানের ওপর। পরে এ কে এম শামসুদ্দীন নামে আরও একজনকে যুক্ত করা হয়। সংবিধান রচনার কাজে সাহায্য করার জন্য বিচারপতি এফ কে এম মুনীমকে আইন-সচিব নিযুক্ত করা হয়।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে গণপরিষদের বাইরে থেকে নানা ধরনের পরামর্শ-সংবলিত ৯৮টি স্মারকলিপি আসে। সদস্যদের বিবেচনার জন্য এগুলো বিলি করা হয়েছিল।

গণপরিষদে ড. কামাল হোসেন
১২ অক্টোবর কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ১৫৩টি অনুচ্ছেদসংবলিত ৭২ পৃষ্ঠার খসড়া সংবিধান বিল আকারে গণপরিষদের সামনে পেশ করেন। ১৯ অক্টোবর বিলের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয় যা চলে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। গণপরিষদের ৪৫ সদস্য খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনা করেন। তাদের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন ১৬ জন। সাধারণ আলোচনার বাইরেও কমিটির সভাপতি হিসেবে ড. কামাল হোসেন অনেক সদস্যের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

এ কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ (১৯১৭—১৯৯৫)
সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘সর্বশক্তিমান, পরম দয়ালু, ক্ষমাশীলের নামে’ কথাগুলো যুক্ত করার প্রস্তাব করেন কমিটির সদস্য এ কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ। তার যুক্তি ছিল, দেশের জনগোষ্ঠীর ৮৩ শতাংশ মুসলমান। যারা তাদের সব কাজ সর্বশক্তিমানের নামে শুরু করে। নোট অব ডিসেন্টে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করেন হাফেজ হাবীবুর রহমান। তিনি সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ বাতিলসম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কড়া ভাষায় আপত্তি জানান। তার মতে, এতে দলীয় একনায়কত্ব এবং দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টি হবে। ৭০ অনুচ্ছেদের পুনর্লিখনের প্রস্তাব করেন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী।

হাফেজ হাবীবুর রহমান (১৯১৫—১৯৮৫)
৭০ অনুচ্ছেদ এবং সম্পত্তির অধিকারসম্পর্কিত সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে বড় ধরনের আপত্তি জানান আছাদুজ্জামান খান। তার মতে, একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরের ব্যক্তি সম্পত্তিকে আইন দ্বারা জাতীয়করণ করার প্রয়োজন রয়েছে। এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পদ এবং উৎপাদন পদ্ধতির যৌথ মালিকানাকে সংবিধানের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা; শহরে কিংবা গ্রামে ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া; নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান না রেখে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান বিধান করারও প্রস্তাব দেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল শিডিউলড কাস্ট, শিডিউলড ট্রাইব এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে বিশেষ যত্নের সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকতা করাকে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। ৬ সদস্যের এই নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত কমিটির রিপোর্টের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
সংবিধান গৃহীত ও স্বাক্ষর
৪ নভেম্বর খসড়া সংবিধানের তৃতীয় ও চতুর্থ পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। এদিন দুপুরে তুমুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের সদস্যগণ হাতে লেখা সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষর করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হয়।
তথ্যসূত্র: আমীন আল রশীদ, সংবিধান প্রণেতাগণ (প্রথ খণ্ড), শিলালিপি/২০২৪

