প্রতিটা দেশের একটা সম্ভাব্য শত্রু থাকে। সেভাবে তার সামরিক কৌশল ঠিক করা হয়। তার সীমান্তব্যবস্থাপনা কেমন হবে; সমরাস্ত্রে সে কতটা শক্তিশালী হবে; কোন কোন দেশ থেকে সমরাস্ত্র কিনবে; তার পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে—ইত্যাদি নির্ভর করে সে তার প্রতিবেশী দেশসমূহের কাছ থেকে কতটা হুমকিতে রয়েছে, তারওপর।
আশপাশের দেশগুলোয় যদি শান্তির সংকট থাকে বা সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে, তখন প্রতিবেশী হিসেবে তাকে সতর্ক থাকতে হয়। অপেক্ষাকৃত বড় দেশ তার প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর ওপর নানাভাবে খবরদারি করতে চায়। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ভেতর দিয়ে অভিন্ন নদী বয়ে গেলে তার পানি বণ্টন, চোরাচালান, মানবপাচার, মাদকের কারবার এমনকি সন্ত্রাসবাদের মতো ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশে আয়তনে ছোট হলেও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত একটি বদ্বীপ রাষ্ট্র বলে প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার তো বটেই, আরেকটি অদূরবর্তী প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং কিছুটা দূরবর্তী চীনের সঙ্গেও তাকে নানাবিধ হিসাব-নিকাশ করে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য শত্রুরাষ্ট্র কে বা কার সাথে তার যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধাবস্থা তৈরি হতে পারে, ভারত না মিয়ানমার? এর উত্তর হচ্ছে দুটি দেশই। ভারতের সঙ্গে যদিও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। বিশেষ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াতেই এই দেশটির ভূমিকা অবস্মরণীয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নানা ইস্যুতেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব তৈরি হয়েছে—যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত বছরের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে। এই ঘটনার পরে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে উত্তেজনা যেমন বেড়েছে, তেমনি উভয় দেশের সরকার ও স্টেকহোল্ডারদের নানা বক্তব্য সম্পর্ক আরও খারাপ করেছে। বন্ধুপ্রতিম দুটি দেশের মধ্যে এখন কার্যত ভিসা আদান-প্রদানও বন্ধ। নিকটতম প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে ভিসা আদান-প্রদানও বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো সুস্থ কূটনীতির লক্ষ্মণ নয়। সেটা যেকোনো দেশের জন্যই।
অভ্যুত্থানের পরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণ ওই অভ্যুত্থানে যাদের পতন হয়েছে, সেই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তারা ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে এবং ভারতের আশির্বাদে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের ‘শত্রুরাষ্ট্র’ পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো হয়েছে। যোগাযোগ বেড়েছে। যদিও ১৯৭১ সালে এই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। যে যুদ্ধে ভারত সরাসরি বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল শরণার্থী হিসেবে। সুতরাং সেই পাকিস্তানের সঙ্গে যদি বাংলাদেশ সুসম্পর্ক গড়ে তোলে, সেক্ষেত্রে ভারত তার প্রধান ‘শত্রুরাষ্ট্র’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পথ খুঁজবে—সেটি অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং এখন যদি সত্যি সত্যি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে? বাংলাদেশ কি কাউকে সমর্থন দেবে বা কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াবে? ড. ইউনূস কি সে কারণেই যুদ্ধের প্রস্তুত নিয়ে রাখতে বললেন?
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪ হাজার ১৪২ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যা বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ স্থলসীমান্ত। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা পরিবেশে পাকিস্তান একটি প্রভাবশালী খেলোয়াড়। ভারত-পাকিস্তান মধ্যে বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষ শুরু হলে তার অভিঘাত সরাসরি বাংলাদেশের সীমান্তে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় এবং অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হতে পারে।
পাকিস্তান সরাসরি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো বড় প্রভাব ফেলতে পারে না, তবে কিছু মতাদর্শগত ও কৌশলগত শক্তি মাঝে মাঝে পাকিস্তানের নাম ব্যবহার করে থাকে। এ কারণে ভারত যদি পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক বা কূটনৈতিক উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সে সময় বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বাড়লে ভারত তার নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগ বাড়াবে—এটি যেমন স্বাভাবিক, তেমনি এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী ভূমিকা নেবে—সেটি নির্ভর করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের কৌশলের ওপর।
কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পরে নিরাপত্তা জোরদার
কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তান যখন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে বলে মনে করা হচ্ছে, সেই সময়ে গত বুধবার (৩০ এপ্রিল) বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মহড়া পর্যবেক্ষণ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বর্তমান বিশ্বে চারদিকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি থাকায় প্রস্তুতি না নিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, ‘অনেকের মতো আমিও যুদ্ধবিরোধী মানুষ। পৃথিবীতে যুদ্ধ হোক, এটা কামনা করি না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে প্রস্তুতি না নেওয়াটা আত্মঘাতী এবং প্রস্তুতি নিতে হলে আধাআধি প্রস্তুতির কোনো জায়গা নেই। এটা এমন এক পরিস্থিতি, জয়ই একমাত্র অপশন। পরাজয় এখানে কোনো অপশন হতে পারে না। কাজেই আমাদের প্রস্তুতি কত উচ্চ পর্যায়ে নিতে পারি, তার চেষ্টা থাকতেই হবে।’
বিমান বাহিনীর অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি সত্যিই যুদ্ধে জড়াবে বা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জড়ালে তার অংশ হবে? হয়তো না। কিন্তু যুদ্ধে না জড়ালেও সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখা নানা কারণেই জরুরি। নিজের দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য তো বটেই। যদিও বাংলাদেশের মতো একটি দুর্বল অর্থনীতির দেশ সামরিক খাতে কতটা শক্তিশালী হবে বা হতে পারবে—সেটি আরেকটি তর্ক। কেননা মাথায় রাখতে হবে, মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশে প্রায় ২০ কোটি মানুষ বসবাস করে—যাদেরকে প্রতিনিয়ত খাদ্য-বস্ত্রী-বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ নিয়েই চিন্তা করতে হয়। সুতরাং সামরিক খাতে অনেক বেশি ব্যয় করার সুযোগ নেই। কিন্তু ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় অবস্থিত বলে বাংলাদেশ যদি সামরিক দিক দিয়ে খুব দুর্বল হয়ে থাকে, সেটিও কাজের কথা নয়।
ভারত-পাকিস্তান এই উত্তেজনার ভেতরেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তও অস্থির। পুরো সীমান্তে এখন মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মিন নিয়ন্ত্রণ এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রধান ভূমি রাখাইন রাজ্যটিও আরাকান আর্মির দখলে। সেখানে মিয়ানমার সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আগে থেকে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে সম্প্রতি আরও এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা যু্ক্ত হয়েছে। রাখাইনে দুর্ভিক্ষের মতো মানবিক সংকটের আশঙ্কা করে সেখানে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের কাছে করিডোর চেয়েছে জাতিসংঘ। যদিও বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়। যদি রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশকে সত্যিই করিডোর দিতে হয় তাহলে সেটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বে কোনো ধরনের হুমকি তৈরি করবে কি না বা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হবে কি না, তা বলা যায় না। সুতরাং এই বাস্তবতায় মাথায় রেখেও হয়তো ড. ইউনূস যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখতে বলেছেন।
তবে এটা ঠিক যে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ও রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণের ফলে যা কিছু ঘটছে, তার অনিবার্য পরিণতি কী হবে, তা এখনই বলা কঠিন, কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বিষয়ে প্রস্তুত থাকা দরকার:
১. সীমান্ত গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা।
২. বিমান ও নৌ-সীমায় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।
৩. সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্যযুদ্ধ মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়ানো।
মনে রাখতে হবে, সামরিক উত্তেজনা কেবল নিরাপত্তার বিষয় নয়, বরং এটি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি খরচ, খাদ্য নিরাপত্তা ও বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টিও কারণ হতে পারে। এজন্য বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত হবে অর্থনৈতিক প্রস্তুতি নেওয়া, যেমন: জরুরি খাদ্য ও জ্বালানির মজুদ, রেমিট্যান্স প্রবাহের সুরক্ষা, কূটনৈতিক বাণিজ্য বিকল্প প্রস্তুতি ইত্যাদি।
সর্বোপরি, বাংলাদেশ সরাসরি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার অংশ না হলেও এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ‘নিরপেক্ষ’ থাকা মানেই ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকা নয়। বরং সতর্কতা, প্রস্তুতি ও কৌশলগত সক্রিয়তা—এই তিনটি মিলে বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ, আত্মনির্ভর ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দিতে পারে। ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’—সারা পৃথিবীতেই এটা খুব জনপ্রিয় স্লোগান। কিন্তু শান্তিকে রক্ষা করার জন্য সামরিক প্রস্তুতি থাকাও আবশ্যক।