সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ গেলে কী হবে?

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন তুলে দিচ্ছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ

গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সংবিধান সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে বেশ কিছু সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সুপারিশ ‘বৈপ্লবিক’। যেমন বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন। কমিশনের প্রস্তাব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম হবে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এসে দেশের সাংবিধানিক নাম কেন পরিবর্তন করতে হবে, দেশের মানুষ আদৌ এই পরিবর্তন চায় কি না, এই বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠবে কি না, সেটি আরেক তর্ক।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন রাষ্ট্রের জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, সেই সংবিধানের প্রস্তাবনাও নতুন করে লেখার সুপারিশ করেছে কমিশন। তারা একটি প্রস্তাবিত প্রস্তাবনাও এর সাথে যুক্ত করেছে—যেখানে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

প্রস্তাবনাটি এরকম: ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, যারা এই ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি; আমরা সকল শহীদের প্রাণোৎসর্গকে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে অঙ্গীকার করছি যে, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের যে আদর্শ বাংলাদেশের মানুষকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীনতার যে আদর্শ ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করেছিলো, সেই সকল মহান আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে; আমরা জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করছি, যে সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এবং যে সংবিধান স্বাধীন সত্তায় যৌথ জাতীয় বিকাশ সুনিশ্চিত করবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করবে; আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, এই সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে পরস্পরের প্রতি অধিকার, কর্তব্য ও জবাবদিহিতার চেতনায় সংঘবদ্ধ করবে, সর্বদা রাষ্ট্র পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার নীতিকে অনুসরণ করবে এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখবে; জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি।’

মূলনীতি বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব

সংবিধানের বিদ্যমান চারটি মূলনীতির (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা) মধ্যে তিনটি বাদ দিয়ে শুধু ‘গণতন্ত্র’ রেখে একটি নতুন মূলনীতি তারা যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। সেটি হলো ‘বহুত্ববাদ’। এই দুটির সঙ্গে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময় জারিকৃত প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স বা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত তিনটি অধিকার ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ যুক্ত করারও সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ কমিশনের প্রস্তাবমতে সংবিধানের মূলনীতি হবে পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। যদিও বলা হয় যে, গণতন্ত্রের মধ্যে বাকি সবগুলোই কাভার করে। অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্র যদি শুধু তার নাগরিকের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারে তাহলে সেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সুবিচার ও বহুত্ববাদ—সবই চলে আসে।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণপরিষদ

ইরেজি সেক্যুলারিজমের বাংলা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ হয় কি না সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শব্দটি সাধারণ মানুষের বোধগম্য। অনেকে সেক্যুলারিজমের বাংলা ‘ইহজাগতিকতা’ লিখতে ও বলতে পছন্দ করেন এবং এটিই অধিকতর শুদ্ধ বলে মনে করেন। কিন্তু শব্দের এই মারপ্যাঁচে না গিয়েও এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, আধুনিক রাষ্ট্র মানেই ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মীয় রাষ্ট্র বা কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে বাকি সব ধর্মের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন সংবিধানটি পুরোপুরি ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত ছিল। এমনকি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এ কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান পরম করুণময় দয়াময়ের নামে’ যুক্ত করার প্রস্তাব দিলেও সেটি গৃহীত হয়নি।

গণপরিষদে ড. কামাল হোসেন, ১৯৭২

১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের সংবিধান বিল উত্থাপন করেন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন। এরপরই সংবিধানের ওপর দীর্ঘ বক্তৃতা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ- যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’ (ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম, বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, সিসিবি ফাউন্ডেশন/২০১৪, পৃ. ৭০)।

গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭২

১৯ অক্টোবরের বৈঠকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এমনই এক আদর্শ, যা গ্রহণ না করলে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র কোনোদিনই গ্রহণ করা যায় না। আমরা এমন একটা মানবগোষ্ঠী এই ৫৪ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে, যাদের ভাষা এক, যাদের জীবন ও ধ্যান-ধারণার বোধ এক, কিন্তু ধর্ম বিভিন্ন। আমরা একটা compact জাতি হিসাবে বাস করছি। আমাদের এই ঐক্যবোধ কেউ বিনষ্ট করতে পারবে না।

সৈয়দ নজরুল বলেন, এ দেশে ধর্মকে নোংরামীর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যে ধর্ম মহাপুরুষরা মানব-জাতির কল্যাণের জন্য প্রচার করেছিলেন এবং যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক জ্ঞান যে ধর্মের সাহায্যে বিকশিত হয়েছে, সেই মহান ধর্মকে রাজনৈতিক কারণে অপব্যবহার করা হয়েছে। বিগত মহাযুদ্ধে-স্বাধীনতা যুদ্ধে- যে ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে, ধর্মের নামেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের সময় যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তাদেরও ধর্মের নামে হত্যা করা হয়েছে। ধর্মের এভাবে অবমাননা পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয়েছে কিনা সন্দেহ। ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে দিলে এ রকম অবমাননা হয়। সেজন্যই যারা সংবিধান রচনা করেছেন, সেই খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির খসড়া সংবিধান রচয়িতারা ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেছেন। (গণপরিষদ বিতর্ক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১)।

২০ অক্টোবরের বৈঠকে এম মনসুর আলী বলেন, দীর্ঘকাল এই দেশের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং তার স্বাক্ষর আমরা পেয়েছি বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে। সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন মানুষের আত্মাহুতির মধ্যে তার স্বাক্ষর আমরা পাই।

এদিনের বৈঠকে মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, সংবিধানে এই গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে যে, ব্যক্তিজীবনে যার যেটুকু ধর্ম, সে সেই ধর্ম অনুসরণ করবে, অনুশীলন করবে। কেউ তাতে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারবে না। কিন্তু ধর্মকে যাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা না হয়, সংবিধানে তারও নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।

সরদার আমজাদ হোসেনের ভাষায়, ধর্ম বহুকাল, বহু যুগ ধরে এ দেশের মানুষের উপর শোষণের হাতিয়াররূপে নেমে এসেছে। ইউরোপ থেকে এ দেশে বয়ে আনা হয়েছে এবং সেই ধর্ম দিয়েই দীর্ঘ চব্বিশ বৎসরকাল শাসন করা হয়েছে আমাদের এ দেশ। তাই আমাদের শাসনতন্ত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ রেখেছি।…তবে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, এ কথা আমাদের নিশ্চয়ই পরিষ্কার করে জানা দরকার। ধর্ম রক্ষার জন্য, ধর্মীয় অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য, অত্যাচার থেকে মুক্তি, মোহমুক্তির জন্য আজ আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী শাসনতন্ত্রের মধ্যে রেখেছি। কারণ, আমরা দেখেছি, মিলিটারি শাসনকালে তারা ধর্মের নামে জেহাদ ঘোষণা করে যুদ্ধ করেছে। ধর্মের নামে পশ্চিমা বাহিনী এ দেশের মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমরা আমাদের নিজস্ব এলাকা দখলের পরে দেখেছি যে, তারা যেসব বাঙ্কার করেছিল, সেখানে মেয়েদের শাড়ি, গয়না, চুড়ি ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্য যে অবস্থান থেকে পশ্চিমা বর্বররা যুদ্ধ করেছে, সেখানে এ ধরনের ধর্মবিরুদ্ধ কাজ করতে তারা মোটেও কুণ্ঠাবোধ করে নাই। নির্লজ্জতার এই দৃষ্টান্ত আমরা পেয়েছি। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে আমরা পরিষ্কারভাবে শাসনতন্ত্রে রেখেছি। (গণপরিষদ বিতর্ক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯)।

২৫ অক্টোবরের বৈঠকে বর্ষিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান আসাদুজ্জামান খান বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা আমরা নিশ্চিত করেছি। ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বন্ধ করে এই সব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এবং সে ব্যবস্থা আমরা করেছি।

তিনি আরও বলেন, ধর্মের যে মূল উদ্দেশ্য, তা এতদিন প্রতিপালিত হয় নাই। ইসলামের নামে পাকিস্তানের বর্বর, স্বৈরাচারী পশুরা একরাত্রে বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ দেশের যুবক, যুবতী, নারী, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, রোগী ও শিশুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আগুন দিয়ে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর তারা যখন চলে যাচ্ছিল, তখন মেশিনগান দিয়ে তাদের মাথা গুঁড়া করে দেওয়া হয়েছিল। এক কোটি নিরপরাধ মানুষকে দেশ থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তিন কোটি মানুষকে নিরাশ্রয় হয়ে বনে জঙ্গলে ফিরতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়- তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ধ্বংস করেছিল যারা, তারা বলেছে, আমরা মুসলমান; আমরা এসব করেছিলাম ইসলাম রক্ষা করার জন্য।

ড. কামালের ভাষ্য

২০১০ সালে যখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়, তখন ড. কামাল হোসেনের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নের সময় মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যুক্ত করার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন: অনেকেই বলেছে আহা মুসলমান প্রধান দেশ। ধর্মনিরপেক্ষতা কী করে হয়। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হলো অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে স্বীকৃতি দেয়া। ১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটানো হবে। ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেয়া যাবে না। শুধু শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে হবে না। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মানে ধর্ম গেল বিষয়টা তো তা না। এ নিয়ে তখনও অনেকে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। এই বিভেদ থেকে মানুষকে মুক্ত করুন। মানুষকে এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব আপনাদের, এই  নতুন প্রজন্মকে নিতে হবে। ধর্মের নামে কী হয়েছে…। একাত্তরে কী হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাকে বাতাস দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলা হলো। আমরা শুনেছি পাকিস্তানি অনেক সেনা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছে। কারণ তারা দেখলো তারা মুসলমানদেরই মেরেছে। আমরা যেটা বলি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটানো। (আমীন আল রশীদ, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী: আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক, ঐতিহ্য/২০১১, পৃ. ২৬)।

পঞ্চম, অষ্টম ও পঞ্চদশ সংশোধনী

১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে রাষ্ট্রপতির দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ নম্বর ৪-এর দ্বিতীয় তফসিলবলে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) যুক্ত করা হয়—যাকে পরের বছর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল গৃহীত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়। এর ৩২ বছর পরে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করা হলেও প্রস্তাবনা থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ বাদ দেয়া হয়নি। তবে এর অনুবাদে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এখন সংবিধানের শুরুটা এরকম: ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে।’

বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ২ নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয় ছিল প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানা। কিন্তু ১৯৮৮ সালে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী এনে ‘২ক’ নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাষ্ট্রধর্মের বিধান করেন। সেখানে বলা হয়: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’

২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতিসহ অনেক বিধান ফিরিয়ে আনা হলেও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা হয়। তবে বাক্যটি সর্বজনীন করার চেষ্টা করা হয়। যেমন সংবিধানে এখন রাষ্ট্রধর্মের অনুচ্ছেদটি এরকম: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা না হলেও এই অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে ইসলামের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মকে সমমর্যাদা দেয়া হয়। যদিও কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে অন্য ধর্মের সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি একধরনের গোঁজামিল ছাড়া কিছু নয়। সবচেয়ে বড় গোঁজামিল প্রস্তাবনায় বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি ঘোষণা।

এই সময়ে কেন ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিলের সুপারিশ?

সংবিধান সংস্কার কমিশন মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলেও সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম’ এবং রাষ্ট্রধর্ম ইস্যুতে কোনো সুপারিশ করেনি। তার মানে প্রস্তাবনায় বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার পক্ষেই কমিশনের অবস্থান। যদি তাই হয় তাহলে মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে সংবিধানকে আরও বেশি সাম্প্রদায়িক করার পথে কমিশন কেন হাঁটছে—সেটি বিরাট প্রশ্ন।

ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার দৃশ্য, ১৯৯২

বস্তুত, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির রাজনীতি যত কট্টর বা উগ্রবাদী হোক না কেন, বহু বছরের চর্চার মধ্য দিয়ে ভারত সারা বিশ্বে নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রমাণের চেষ্টা করেছে। গুজরাট ট্রাজেডির মতো সেখানেও সংখ্যালঘুরা নানাভাবে নিপীড়িনের শিকার হলেও সামগ্রিকভাবে ভারত যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা বিশ্বকে দেখাতে চায় বা দেখাতে পারে, সেখানে মূল ভূমিকা পালন করে তাদের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি।

একইভাবে বৈশ্বিক মিডিয়া, বিশেষ করে ভারতের গণমাধ্যম এমনকি সে দেশের ক্ষমতাসীন বিজেপির অনেক নেতা বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বলে এবং একসময় এখানে উগ্র ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল বলে বা এখনও মাঝেমধ্যে মাজার, দরগাহ, কবরস্থান, বাউল-ফকিরদের আস্তানায় ভাঙচুর, তাদের অনুষ্ঠানে হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্র বলার বা লেখার যে সুযোগ পায়—সেই সুযোগটি আরও বেড়ে যাবে যদি সংবিধানের মূলনীতি ধেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রাখা হয়। বিদেশিদের এই সুযোগ  কেন দেয়া হবে সেটি পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগের দিন থেকে বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর হামলা, ধর্মীয় ইস্যুতে মন্তব্যের কারণে মব ভায়োলেন্সের মতো ঘটনা নিয়ে যখন দেশে-বিদেশে সমালোচনা হচ্ছে।

সম্প্রতি ৪০টি মাজার, দরগাহ ও কবরস্থানে হামলা হয়েছে

সম্প্রতি এইসব ঘটনায় পুলিশ যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, গত বছরের ৪ আগস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৪০টি মাজার, দরগাহ ও কবরস্থানে ৪৪টি হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে ঢাকা বিভাগে।  যার সংখ্যা ১৭। চট্টগ্রাম বিভাগে ১০টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৭টি হামলার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। শেরপুর জেলায় একটি মাজারে ৪ বার হামলা হয়েছে। পুলিশের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৪টি হামলার ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়ছে। এর মধ্যে ১৫টি নিয়মিত মামলা এবং ২৯টি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও পুলিশের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সুতরাং এমন একটি মুহূর্তে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাদ দেয়ার সুপারিশ কোনো সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। কেননা এই সুযোগে ভারতের গণমাধ্যম তো বটেই, অন্য আরও অনেক দেশের গণমাধ্যম এই বিষয়ে নেগেটিভ সংবাদ প্রকাশের সুযোগ পাবে। অনেকেই হয়তো এই ঘটনাকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের চাপ বলে সন্দেহ করবে। কেউ কেউ হয়তো এরকমও বলার চেষ্টা করবে যে, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে গেলো বাংলাদেশ ইত্যাদি—যা ড. ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। উপরন্তু এই কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ যেহেতু একজন ‘সেক্যুলার ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে পরিচিত এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন; মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ভালো—ফলে এই ঘটনাটি তার জন্যও বিব্রতকর হবে কি না—সেটিও ভাবা দরকার।

যদি এমন হতো যে মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম এবং প্রস্তাবনা থেকে বিসমিল্লাহ—সবই বাতিলের সুপারিশ করে ‘বহুত্ববাদ’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে, তাহলে তার একটি যুক্তি থাকতো। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ, অথচ রাষ্ট্রধর্ম বহালের অর্থই হলো সংবিধানকে অধিকতর সাম্প্রদায়িক করা এবং ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে আরও বেশি সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দেয়া।

স্মরণ করা যেতে পারে, এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্মের বিধান যুক্ত করেছিলন তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য। এখানে তার ধর্মীয় অনুভূতি তথা পরকালীন কল্যাণ কামনার কোনো বিষয় ছিল বলে মনে হয় না। তাছাড়া দেশের মানুষও তখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানানোর দাবি জানায়নি। আবার যখন এটি করা হলো তখন সাধারণ মানুষ এর বিরোধিতাও করেনি। ভোটের রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও এর বিরুদ্ধে বড় কোনো প্রতিবাদ গড়ে তোলেনি। তবে একাডেমিক পরিসরে এর সমালোচনা হয়েছে। দেশের ১৫ জন বরেণ্য ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। যদিও হাইকোর্ট তা খারিজ করে দিয়েছেন।

গত বছরের ২৫ এপ্রিল ৫২ পৃষ্ঠার যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় সেখানে বলা হয়: সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও আঘাত করে না। সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত মৌলিক নীতিগুলো এবং অন্য কোনো বিধানের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। সংবিধানে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ মর্যাদা প্রদান করা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। অনুচ্ছেদ ২ (ক) অবশ্যই সামগ্রিকভাবে পড়তে হবে এবং পড়লে এটা সুস্পষ্ট হয়, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার ধারণার সন্নিবেশ কোনোভাবেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করে না। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে না এবং সংবিধানে বাহুল্যও সৃষ্টি করে না। (ইত্তেফাক, ২৬ এপ্রিল ২০২৪)। আদালতের এই পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করলে আদালত অবমাননার শঙ্কা রয়েছে। তাই সেদিকে না গিয়ে এটা বলা যায় যে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার পেছনে এরশাদের যে রাজনৈতিক দূরভিসন্ধী ছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বা তাদের সময়ে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের সেটি থাকার কথা নয়।  আবার এও ঠিক যে, তারা সুপারিশ করেছে বলেই সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল হয়ে গেছে তা নয়। বরং এ বিষয়ে যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য না হয় এবং সংসদ যদি এটা অনুমোদন না করে তাহলে এই সুপারিশ কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

কী বলেছেন আহমদ ছফা

সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলগুলো আদৌ ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করেছে কি না বা রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে বিযুক্ত রেখেছে কি না, রাখতে চেয়েছে কি না এবং রাখতে পেরেছে কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন।

আহমদ ছফা লিখছেন: ইংরেজি ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ যদি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ধরে নেওয়া হয়, আওয়ামী লীগ দলটি প্রথম থেকেই ধর্মীয় ভাববাষ্পের অন্তরাল থেকে জনগণের মন মানসিকতাকে পরিচ্ছন্ন করার উদ্দেশ্যে কোনো কর্মসূচিই গ্রহণ করেনি। ফলে আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মকাণ্ড অসাম্প্রদায়িক হলেও তাকে ঠিক সাম্প্রদায়িকতামুক্ত রাজনৈতিক সংগঠন বলার উপায় নেই কিছুতেই। বরং বলা যায় সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের গর্ভ থেকেই আওয়ামী লীগের উদ্ভব।

যুদ্ধের পর নানা সম্প্রদায় মিলেমিশে এখানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার যে সুস্থ বিকাশক্ষেত্র রচিত হওয়ার কথা ছিল, তার সঠিক সূচনাটিও হতে পারেনি। আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং বিভেদরেখা না কমে আরো স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সর্বসান্ত্ব। তারা আশা করেছিল যে স্বাধীনতার পর তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের হাতে নিগৃহীত হবে না। সব ব্যাপারে সমান সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখা গেল, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মনোভাব অনেক বেশি বিষিয়ে গেছে। তারা তাদের দিকে অধিকতর সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতে আরম্ভ করেছে। যুদ্ধের সময় যারা ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের ঘরবাড়ি সবকিছু সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোকদের হাতে পড়েছে। সেগুলো দাবি করাতে অধিকতর তিক্ততার সৃষ্টি হল। (আহমদ ছফা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা, খান ব্রাদার্স/২০১২, পৃ. ৫০)।

পরিশেষে…

সমাজতাত্ত্বিক ও লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হকের একটি মন্তব্য দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক: অনেক লোকেই মনে করেন, ধর্ম ছাড়লে মানুষ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নৈতিক অবলম্বন হারাবে এবং তাতে মানুষ বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যাবে, মানবিক গুণাবলি হারিয়ে মানুষ জন্তু-জানোয়ারের পর্যায়ে নেমে যাবে। গণতন্ত্রী কিংবা সমাজতন্ত্রীদের থেকে বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর কোনো নৈতিক অবলম্বন মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি বলে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে লোকে ধর্মের পূর্ণাঙ্গ বিকল্প রূপে পায় না। আর সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত লোকে গণতন্ত্রী বলে আত্মপরিচয়দানকারীদের দেখতে পায় যুদ্ধবাজ ও দুর্নীতিবাজ রূপে। (আবুল কাসেম ফজলুল হক, রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি, জাগৃতি প্রকাশনী/২০১১৬, পৃ. ২০)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top