সংবিধান প্রণেতাগণ-৫: আওয়ামী লীগ ও বাকশাল
একীভূত করায় ভূমিকা রাখেন মো. লুৎফর রহমান
প্রভাবশালী এমপির সংসারেও মাস শেষে টানাটানি!
মো. লুৎফর রহমান (২৩ জুলাই ১৯২৭- ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮)
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নে গঠিত কমিটিতে অধিকাংশ সদস্যকে মনোনীত করা হয়েছিল তাঁদের আইন বিষয়ে পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতার কারণে। কিন্তু ৩৪ জনের মধ্যে হাতেগোণা যে কয়জন সদস্যের ‘ল ব্যাকগ্রাউন্ড’ ছিল না, লুৎফর রহমান তাঁদের অন্যতম। তিনি তখন গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি নিয়ে গঠিত রংপুর-৪ (জাতীয় পরিষদ ৪) আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্য।
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। কিছুদিন সাংবাদিকতা করায় লেখালেখির চর্চা ছিল। প্রচুর পড়াশোনা করতেন। আইন ও সংবিধান বিষয়ে তিনি অভিজ্ঞ না হলেও রাজনৈতিক নানা বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। তিনি ছিলেন মাটিলগ্ন রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধু হয়তো তাঁকে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে তাঁর সাংবাদিকতা, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে তাঁর জানাশোনা এবং সর্বোপরি প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছেন।
লুৎফর রহমানের ছেলে সাজ্জাদুর রহমান জানান, বাবার কাছ থেকে তাঁর সংবিধান প্রণয়নকালীন অভিজ্ঞতা শুনতে গিয়ে তিনি জেনেছেন, গণপরিষদে যখন খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছিলো; যখন অনেকেই সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ বাতিলসম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সমালোচনা করছিলেন; কেউ কেউ এই বিধান বাতিলেরও দাবি জানাচ্ছিলেন—তখন লুৎফর রহমান এই বিধানের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। কেননা তিনি মনে করতেন, এরকম একটি বিধান সংবিধানে না থাকলে দল ভাঙাগড়ার খেলা চলতে থাকবে। সংসদ অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
মাহাবুব এলাহী রঞ্জু বীর প্রতীক কাছ থেকে দেখেছেন লুৎফর রহমানকে। তিনি বলেন: ‘লুৎফর রহমানের একটা গাড়ি ছিল না। রিকশায় চলাফেরা করতেন। কিন্তু আমার কাছে তাঁর সম্মান এখন যে নেতারা মার্সিডিজে চড়েন, তাদের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি দেশের জন্য, দলের জন্য যে কষ্ট করেছেন, ত্যাগ করেছেন, পায়ে হেঁটে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন, সেটা আজকের বাংলাদেশে অতুলনীয়। পাকিস্তানের মতো একটা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে আমরা যে বাংলাদেশ নামে একটা আলাদা রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললাম, এটা কি সহজ কথা? এটা কী করে সম্ভব হলো? লুৎফর রহমানের মতো মানুষদের জন্যই তো।’
জন্ম ও বেড়ে ওঠা: গাইবান্ধা কলেজের প্রথম ছাত্র
১. অষ্টম সংসদের সদস্যগণের জীবনবৃত্তান্তের প্রচ্ছদ; ২. ছেলে সাজ্জাদুর রহমানের সঙ্গে লুৎফর রহমান (১৯৯১)
জাতীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত সংসদ সদস্যদের জীবনবৃত্তান্ত (২০০৫) অনুযায়ী, লুৎফর রহমানের জন্ম ১৯৩০ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রে এই তারিখ উল্লিখিত রয়েছে। কিন্তু পরিবারের দাবি, লুৎফর রহমানের জন্ম ২৩ জুলাই ১৯২৭। পরিবারের সদস্যদের ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেটে লুৎফর রহমানের জন্ম পয়লা ফেব্রুয়ারি ১৯৩০ লেখা হয়েছিল। সে কারণে হয়তো জাতীয় সংসদের বইতে ওই তারিখটি ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে তাঁর জন্ম ১৯২৭ সালে এবং তাঁরা বছরের পর বছর ধরে লুৎফর রহমানের জন্ম তারিখ ২৩ জুলাই জেনে এসেছেন। সাজ্জাদুর রহমানও জানান, তাঁর বাবাই তাঁকে নিজের জন্ম ১৯২৭ বলে উল্লেখ করেছেন।
লুৎফর রহমানের জন্ম গাইবান্ধা শহরের পলাশপাড়া এলাকায় এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবা নাসিম উদ্দিন সরকার ছিলেন কৃষক। মা মফিজান নেসা খাতুন গৃহিণী।
লুৎফর রহমান ১৯৪৭ সালে গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫০ সালে গাইবান্ধা কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯৫২ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। তিনি গাইবান্ধা কলেজের প্রথম বর্ষের প্রথম ছাত্র হিসেবে নাম নিবন্ধন করেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালে।
রাজনীতি: ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা ও গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়
পরিবারের সদস্যরা জানান, লুৎফর রহমান যখন গাইবান্ধা কলেজের ছাত্র, তখন ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুস সোবহানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। বঙ্গবন্ধু তাঁকে রাজনীতিতে আসার পরামর্শ দিলে লুৎফর রহমান বলেন: ‘রাজনীতি করে নবাব জমিদাররা। আমাদের মতো সাধারণ লোক কী করে রাজনীতি করবে?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘রাজনীতি এইসব অভিজাত শ্রেণির হাত থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের হাতে আনতে হবে। তাদের ভাগ্য উন্নয়ন করতে হবে—এটাই আমার রাজনীতি।’ এরপর তিনি আজীবন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন। কখনো লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করে আদর্শচ্যুত হননি। রাজনীতিতে তিনি নিজের মেধা, সাংগঠনিক দক্ষতা, অতুলনীয় সততা ও আত্মত্যাগের কারণে অল্পদিনের মধ্যেই গাইবান্ধার রাজনীতির প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
১৯৪৮ সালে গাইবান্ধা মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে লুৎফর রহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৪৯ সালে তিনি যুবলীগের গাইবান্ধা মহকুমা সভাপতি এবং ১৯৫১ সালে মহকুমা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ হন। তিনি ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৬ সালে তিনি যুগপৎভাবে গাইবান্ধা মহকুমা ও বৃহত্তর রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি আইয়ুব-বিরোধী সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক হিসেবে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বৃহত্তর রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ ও গাইবান্ধা মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধু তৃতীয়বার গাইবান্ধায় যান ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। লুৎফর রহমান তখন গাইবান্ধা মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওই সফরে গাইবান্ধা মিউনিসিপ্যালিটি পার্কে (বর্তমানে স্বাধীনতার বিজয়স্তম্ভ চত্বর) যে জনসভা হয়, সেটি পরিচালনা করেন লুৎফর রহমান। এদিন বঙ্গবন্ধু রাত্রিযাপন করেন লুৎফর রহমানের বাসায়।
বঙ্গবন্ধু চতুর্থবার গাইবান্ধায় যান ১৯৬৯ সালে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পরে তিনি সাংগঠনিক সফরে বের হন। এরই অংশ হিসেবে তিনি গাইবান্ধায় যান। ওই সফরে তিনি মহকুমা আওয়ামী লীগের আয়োজনে কর্মীসভায় বক্তৃতা করেন। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন লুৎফর রহমান।
বঙ্গবন্ধু পঞ্চমবার গাইবান্ধায় যান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রচার করতে। ১৮ জুন গাইবান্ধা ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে যে বিশাল জনসভায় তিনি ভাষণ দেন, সেখানেও সভাপতিত্ব করেন লুৎফর রহমান। উল্লেখ্য, ওই জনসভায় এত বিপুল মানুষের সমাগম হয় যে, মাঠে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। অনেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখা এবং তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য স্কুলের টিনের চালে উঠে যান। মানুষের ভারে সেটি ভেঙে পড়ে। অনেকে আহত হন। একজনের মৃত্যুর খবরও শোনা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেষবার গাইবান্ধায় যান ১৯৭৩ সালে। সাধারণ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করেন। বিশাল ওই জনসভায় লুৎফর রহমান সভাপতিত্ব করেন। (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা, গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন, মার্চ ২০২০, পৃষ্ঠা ১১৯-১২২)।
মুক্তিযুদ্ধ: মাইকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা, গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন/মার্চ ২০২০, পৃষ্ঠা ১২৫
লুৎফর রহমান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগে তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গাইবান্ধায় এসে জনসংযোগ করতে থাকেন। ১৯৭১ সালে মার্চের মধ্য ভাগে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট মহকুমা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করলে তিনি ওই ঘোষণার ওয়ারলেস কপি সংগ্রহ করে গাইবান্ধায় মাইকে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। আনসার ক্লাব থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে স্থানীয় যুবকদের অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তৎকালীন এসডিও অস্ত্র দিলে চাকরি হারাবেন জানালে লুৎফর রহমান নিজের প্যাডে অস্ত্রসমূহ নিজ অধিকারে নেয়ার ঘোষণা করে সেই চিঠি এস.ডি.ওর হাতে তুলে দেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি গাইবান্ধায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশ করলে সীমান্ত পেরিয়ে তিনি ভারত চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি নর্দান জোনাল কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য এবং মানকার চরে মুক্তিযুদ্ধ যুবশিবিরের প্রধান ছিলেন।
লুৎফর রহমানের তৃতীয় কন্যা জেবুন নাহার শিউলী বলেন: ‘আব্বা আমাদেরকে রেখে ভারতে চলে গেলেন। জুলাই মাসের দিকে তিনি মায়ের কাছে চিঠি লিখলেন। সেই চিঠি নিয়ে আমাদের পরিবারে যে কী উচ্ছ্বাস, আনন্দ! চিঠিতে আব্বা আমাদেরকে ভারতে যেতে বললেন। কার সাথে যাব তাও ঠিক হলো। কিন্তু চিঠিটা আসলেই আব্বার কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হলো। কারণ তাঁর অনেক শত্রু ছিল। আব্বা যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা, ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি পাকিস্তানি আর্মি এবং এ দেশীয় দোসরদের টার্গেটে ছিলেন। ফলে এটি কোনো ষড়যন্ত্রও হতে পারতো। আব্বার হাতের লেখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেলো এটি সত্যিই তাঁর চিঠি। মা এবং আমার ভাইবোনেরা ভারতে চলে গেলো। দেশে থাকলাম আমি আমার মেজ বোন কামরুন নাহার। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আব্বা দেশে ফিরে আসেন।’
গণপরিষদে লুৎফর রহমান
লুৎফর রহমান ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি নিয়ে গঠিত রংপুর-৪ (জাতীয় পরিষদ ৪) আসন থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি সংবিধান প্রনয়ণ কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
প্রসঙ্গত, এই কমিটির অধিকাংশ সদস্যকে মনোনীত করা হয়েছিল তাঁদের আইন বিষয়ে পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতার কারণে। কিন্তু ৩৪ জনের মধ্যে হাতেগোণা যে কয়জন সদস্যের ‘ল ব্যাকগ্রাউন্ড’ ছিল না, লুৎফর রহমান তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। তবে কিছুদিন সাংবাদিকতা করায় লেখালেখির চর্চা ছিল। তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। আইন ও সংবিধান বিষয়ে তিনি অভিজ্ঞ না হলেও রাজনৈতিক নানা বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। তিনি ছিলেন মাটিলগ্ন রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধু হয়তো তাঁকে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে তাঁর সাংবাদিকতা, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে তাঁর জানাশোনা এবং সর্বোপরি প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছেন।
সংবিধানের হাতে লেখা কপিতে মো. লুৎফর রহমানের স্বাক্ষর
সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বাবার কাছ থেকে তাঁর সংবিধান প্রণয়নকালীন অভিজ্ঞতা শুনতে গিয়ে তিনি জেনেছেন, গণপরিষদে যখন খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছিলো, তখন স্থিতিশীল সংসদের স্বার্থে লুৎফর রহমান এমপিদের সদস্যপদ বাতিলসম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন।
বাহাত্তর-পরবর্তী রাজনীতি: ‘এরশাদ সেন্টিমেন্টে’ দুবার পরাজিত
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা সদর গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি নিয়ে গঠিত রংপুর-১৯ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে তিনি এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং গাইবান্ধা জেলার গভর্নর মনোনীত হন। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি রংপুর-২০ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মালেক গ্রুপের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। তিনি ওই সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপের দ্বায়িত্ব পালন করেন। একইসঙ্গে জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
১৯৮১ সালের ১০ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি সোভিয়েত রাশিয়া সফর করেন। এরপর সংসদীয় দলের সদস্য হিসেবে তিনি সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফর করেন।
সংসদীয় দলের সদস্য হিসেবে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফরকালে মশিউর রহমান রাঙ্গা (বাম থেকে তৃতীয়) এবং আরও দুই সংসদ সদদেস্যর সঙ্গে লুৎফর রহমান (বামে)
১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিনি অংশ নেননি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি বাকশালের প্রার্থী হিসেবে গাইবান্ধা-২ আসন থেকে নির্বাচন করে হেরে যান। এরপর আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি হেরে যান।
প্রসঙ্গত, নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মুখে পতনের পর এরশাদকে কারাবন্দি করা হলে তাঁর প্রতি উত্তররবঙ্গের মানুষের সমবেদনা বেড়ে যায়। তাদেরকে বোঝানো হয়েছিল যে, এরশাদ উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন বলে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। যে কারণে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে জয়ী হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও তিনি রংপুর ও কুড়িগ্রামের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কয়টিতে জয়ী হন।
জেবুন নাহার শিউলি বলেন, ‘এরশাদ সেন্টিমেন্টের কারণে আব্বা পরপর দুটি নির্বাচনে লাঙল মার্কার কাছে হেরে যান। এ অবস্থায় আমি ২০০১ সালের নির্বাচনি ক্যাম্পেইনে নামলাম। একাধিক জনসভায় বক্তৃতা দিলাম। মানুষের কাছে জানতে চাইলাম, আমার আব্বার অপরাধ কী? যে মানুষটা নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করলেন; রাজনীতির জন্য সংসারটা ঠিকমতো করতে পারলেন না; আমরা সন্তানরা যাঁকে সেভাবে কাছে পাইনি; দলের জন্য যে মানুষটি সবকিছু ত্যাগ করলেন; বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষের পাশে থাকলেন—সেই মানুষটি কেন পরপর দুবার হেরে গেলেন? কোন অপরাধে? এমপি থাকা অবস্থায়ও যে মানুষটির ঘরে মাস শেষে সংসার চালানোর টাকা থাকতো না; যিনি আমাদেরকে বলতেন যে, আমি দেশের জন্য, অসহায় মানুষের জন্য রাজনীতি করি, তোমরা তো তাদের চেয়ে ভালো আছ—এরকম একজন দেশপ্রেমিক মানুষ যখন কষ্ট পায়, তখন সন্তান হিসেবে আমি তো আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করতেই পারি যে, আমার বাবার কী অপরাধ? আপনারা হয় এর জবাব দেবেন, অথবা তাঁকে ভোট দেবেন।’ জেবুন নাহার শিউলি জানান, তাঁর এই বক্তব্য ভোটারদের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তাঁরা দুই হাত তুলে আব্বাকে ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। মেয়ের এমন আবেগঘন বক্তৃতা এবং ভোটারদের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া দেখে লুৎফর রহমানও বিস্মিত হন। এই নির্বাচনে তিনি গাইবান্ধা-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে জয়ী হন এবং জাতীয় সংসদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। (নির্বাচনি ফলাফল পরিশিষ্টে সংযুক্ত)।
আওয়ামী লীগ ও বাকশাল একীভূত করায় ভূমিকা
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করেন, তার অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটি নতুন দল গঠন করেন; সংক্ষেপে যেটি ‘বাকশাল’ নামে পরিচিত।
বাকশাল গঠনের পরে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের কোনো কার্যক্রম ছিল না। তবে এর দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর রাজনৈতিক দল গঠন নীতিমালার আওতায় পুনরায় কার্যক্রম শুরু করে আওয়ামী লীগ।
১৯৮১ সালে দলের সভানেত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরে নতুন করে বিকশিত হতে থাকে আওয়ামী লীগ। কিন্তু তখনও বাকশাল বিলুপ্ত হয়নি। ১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এবং ১৯৭৬ সালের কমিটিতে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে নতুন করে ‘বাকশাল’ গঠিত হয়।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বাকশাল দুটিই সক্রিয় ছিল—যা প্রকারান্তরে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি ও দুর্বলতাই প্রকাশ করে এবং যার সুযোগ নেয় তাদের বিরোধী পক্ষ। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আশাবাদী হলেও দলের নেতারা উপলব্ধি করতে পারেন যে, দলের ভেতরে ঐক্য থাকলে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বাকশাল আলাদা না হলে তাদের এই পরাজয় হয়তো ঠেকানো যেতো। এমতাবস্থায় দলের দুটি ধারাকে একীভূত করার চিন্তাভাবনা শুরু হয় এবং নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস পরে ১৯৯১ সালের ১৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ ও বাকশাল একীভূত হয়। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২)।
আওয়ামী লীগ ও বাকশালকে একীভূত করায় যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের একজন মো. লুৎফর রহমান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে অন্য আরও অনেক নেতার মতো তিনিও বাকশালে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সময়ে গঠিত বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনিও গাইবান্ধা-২ আসন থেকে বাকশালের প্রার্থী হিসেবে (নৌকা মার্কা) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। প্রসঙ্গত, ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বাকশাল অনেক আসনে যৌথভাবে প্রার্থী দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লুৎফর রহমান
লুৎফর রহমানের ছেলে শহীদুর রহমান সাজু জানান, আওয়ামী লীগ ও বাকশালী একীভূত করার বিষয়ে তাঁর বাবার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে। তিনি বলতেন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট ভাগ হয়ে গেছে। না হলে ওই বছর তাদেরই ক্ষমতায় আসার কথা। লুৎফর রহমানের মনে এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল। তিনি মনে করতেন, দলের ভেতরের এই বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। সাজু জানান, আওয়ামী লীগ ও বাকশালকে একীভূত করার জন্য তাঁর বাবা একাধিকবার শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছেন। কারণ তিনি মুজিব অনুসারীদের মধ্যে বিভক্তি চাইতেন না। যে কারণে তিনি বাকশালের প্রধান আব্দুর রাজ্জাকসহ বাকি সবাইকে নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার বিষয়ে কথাবার্তা বলতে থাকেন। সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
আগস্ট ট্র্যাজেডি: সরাসরি জিয়ার দিকে তাকাতেন না
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে খন্দকার মোশতাক নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকেন। কিন্তু তার ডাকে সাড়া দিয়ে যারা ওই বৈঠকে যোগ দেননি, লুৎফর রহমান তাঁদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ সহচর লুৎফর রহমানকে পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ তাঁদের দলে ও মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। লুৎফর রহমান তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বলতেন, তিনি জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে কোনো অনুষ্ঠানে যেতেন না। এমনকি তিনি সরাসরি কখনো জিয়ার দিকে তাকাতেন না। কারণ তিনি মনে করতেন বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী জিয়া।
১৯৭৬-৭৭ সালের বিরুদ্ধ সময়ে তিনি ১৫ আগস্ট উপলক্ষ্যে গাইবান্ধা শহরে কাঙালিভোজের আয়োজন করেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার দলীয় লোকজন তা গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর তিনি শহরের পূর্ব প্রান্তে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সরকারি দলে লোকেরা সেখানেও হামলা চালায়। এরপর বাধ্য হয়ে তিনি নিজের বাড়ি সংলগ্ন স্কুলে কাঙালিভোজের ব্যবস্থা করেন।
একপর্যায়ে খুনী চক্রের হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্য আরও অনেকের মতো আত্মগোপন চলে যান লুৎফর রহমান। আত্মগোপনে থেকেই জোহরা তাজউদ্দিন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীসহ অন্যদের সঙ্গে দল পুনর্গঠনে অংশ নেন। তাঁর জানাজার নামাজের আগে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে দেয়া বক্তৃতায় দুঃসময়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে লুৎফর রহমানের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী (১৯৩৫-২০২২)।
জেবুন নাহার শিউলি বলেন: ‘সামরিক জান্তার কারণে ওই সময় আব্বা এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারেননি। মাঝে মধ্যে তাঁকে মসজিদেও রাত কাটাতে হয়েছে। শুধু দলকে সংগঠিত করার জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে দল গোছানোর কাজে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তখনকার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ আমাদের বাসায় রাত্রিযাপনও করেছেন। বিশেষ করে মতিয়া চৌধুরী আমাদের বাসায় একাধিকবার গিয়েছেন। তিনি গাইবান্ধায় গেলে সার্কিট হাউজ বা অন্য কোথাও থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। আমাদের বাসাতেই থাকতেন।’
বঙ্গবন্ধু যাঁকে বিশ্বাস করতেন সততার জন্য
বঙ্গবন্ধু লুৎফর রহমানকে স্নেহ করতেন তাঁর সততা ও নিষ্ঠার কারণে। তিনি কখনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজনে বঙ্গন্ধুর কাছে কিছু চাননি। একদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, কতজন নিজের জন্য কত কিছুর আবদার নিয়ে আসে। তুই তো কোনোদিন নিজের জন্য কিছু চাস না। উত্তরে লুৎফর রহমান বলেছিলেন, ‘আপনি তো আছেন, আমার আর কিছুর দরকার নেই।’
তাঁর সততার কয়েকটি ঘটনা জানা যায় তাঁর ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে। যেমন: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধু তাঁকে ৮ হজার টাকা দিয়েছিলেন। নির্বাচন শেষে কিছু টাকা বেঁচে যায়। লুৎফর রহমান সেই বেঁচে যাওয়া টাকা বঙ্গবন্ধুকে ফেরত দিতে গেলে তিনি কিছুটা বিস্মিত হন এবং টাকাটা দলের জন্য খরচ করতে বলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানকার চরে মুক্তিযুদ্ধ যুবশিবিরের প্রধান হিসেবে বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত টাকা-পয়সা খরচের দায়িত্ব ছিল লুৎফর রহমানের। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরে তিনি ৯০ হাজার টাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বলেন, এই টাকাটা বেঁচে গেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ওই টাকা এলাকার উন্নয়নে খরচ করার জন্য বলেন।
আরেকটি ঘটনা এরকম: দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। রাস্তা-ঘাট স্কুল-কলেজসহ সব অবকাঠামো বিধ্বস্ত। লোকজন এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ঘোরাঘুরি করত। লুৎফুর রহমান লোকজনকে স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্বুদ্ধ করে এক প্রকল্পের টাকা দিয়ে দুটি কাজ করাতেন। তিনি তাঁদেরকে বলতেন, ‘আপনারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে এই কাজটা করেন। আমি আপনাদের কাজটা করে দেব।’
লুৎফর রহমানের কথা বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করে একটি আদেশ জারি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সেই সময়সীমা পার হওয়ার পরে গাইবান্ধায় লুৎফর রহমানের নির্বাচনি এলাকায় এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির খড়ের গাদা থেকে সাব মেশিনগানসহ ২৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা, এটি ছিল কোনো ষড়যন্ত্র অথবা বোকামি। লুৎফর রহমান বিষয়টি জানতে পেরে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ যার খড়ের গাদায় অস্ত্রগুলো পাওয়া গিয়েছিল, তিনি ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন ভালো সংগঠক ও ভালো মানুষ। এ অবস্থায় লুৎফর রহমান বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু পুরো ঘটনা শোনেন। তিনি জানতেন লুৎফর রহমান কোনো খারাপ লোকের জন্য তদবির করতে আসবেন না। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বিশ্বাস করতেন। এ অবস্থায় আরেকটি প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার জারি করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেয়ার সময় বাড়ানো হয়।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতার শত্রুতার কারণে গাইবান্ধার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) প্রশাসনিক শাস্তির সম্মুখীন হন। অথচ ওই প্রশাসক ছিলেন একজন সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। তিনি উপায়ান্তর না দেখে লুৎফর রহমানের কাছে ছুটে যান। তিনি এসডিওর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হন যে এটা ষড়যন্ত্র। ঘটনাটি এত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল যে, স্থানীয়ভাবে এর সমাধান করা যাচ্ছিল না। তখন তিনি এসডিওকে সাথে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে পুনরায় ঘটনাটি তদন্ত করানোর ব্যবস্থা করেন। ওই তদন্তে অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং এসডিও দায়মুক্ত হন।
জেবুন নাহার শিউলি এবং সাজ্জাদুর রহমান তাঁদের বাবার মুখে শোনা আরেকটি ঘটনা বলেন: ১৯৭৪ সাল। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। বন্যা আর খরার কারণে বরাবরই উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। এক রাতে লুৎফর রহমান তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচরকে নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে আলাপ করছিলেন। বিদ্যুৎ চলে গেলে তাঁরা বেরিয়ে আসেন। হাঁটতে গিয়ে তাঁর পায়ে কিছু একটা বেঁধে যায়। টর্চলাইট জ্বালিয়ে দেখেন একজন মানুষের মৃতদেহ। এই দৃশ্য দেখে সবাই ব্যথিত হন। নিজের নির্বাচনি এলাকায় পায়ে পায়ে লাশ ঘুরবে, তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন। ঘটনা শুনে বঙ্গবন্ধুরও চোখের কোণে পানি জমে যায়। সাথে সাথে তিনি গাইবান্ধার জন্য বিশেষ বরাদ্দের নির্দেশ দেন এবং লুৎফর রহমানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘প্রত্যেক জেলায় যদি তোর মতো একজন করে গভর্নর দিতে পারতাম, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম।’
লুৎফর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধু-অন্তঃপ্রাণ। মনেপ্রাণে তাঁকে ভালোবাসতেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেদিন বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন, সেদিন লুৎফর রহমান আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের পানি ফেলে বলছিলেন: ‘এখন মরে গেলেও আফসোস থাকবে না। বঙ্গবন্ধু আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।’
সাংবাদিক ও সমাজকর্মী লুৎফুর রহমান
২০০২ সালে গাইবান্ধায় কৃষি মেলা উদ্বোধন করছেন লুৎফর রহমান
লুৎফর রহমান ১৯৫৭ সাল থেকে একটানা ৮ বছর দৈনিক সংবাদের গাইবান্ধা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত গাইবান্ধা পৌরসভার কমিশনার হিসেবে পৌর এলাকার বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ করেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখেন। ১৯৬৩ সাল হতে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি গাইবান্ধার প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
২০০২ সালে গাইবান্ধায় মীনা মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লুৎফর রহমান
লুৎফর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষানুরাগী। ওই বয়সেই তিনি প্রায় দুই বিঘা পারিবারিক সম্পত্তি দান করেছিলেন গাইবান্ধা কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য। এছাড়া গাইবান্ধা মহিলা কলেজ, গাইবান্ধা ল’ কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি ভূমিকা রাখেন। এর বাইরে তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় বহু স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। তিনি গাইবান্ধা সরকারি আধুনিক হাসপাতালসহ অনেক দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা এবং এলাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন গাইবান্ধা রেডক্রিসেন্টের আজীবন সদস্য।
পরিবার
সস্ত্রীক লুৎফর রহমান
১৯৫৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা সদর থানার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের সালেহা খাতুনকে (জন্ম ১৯৩৪) বিয়ে করেন লুৎফর রহমান। তাঁর শ্বশুর সাহেব উদ্দিন, শাশুড়ির নাম ছবিজান বেওয়া। লুৎফর রহমানের স্ত্রী সালেহা খাতুন এখনও (নভেম্বর ২০২৩) জীবিত আছেন।
লুৎফর রহমান ৮ সন্তানের জনক। ১. লুৎফুন নাহার রহমান (গৃহিণী), ২. সাইফুর রহমান (মৃত), ৩. কামরুন নাহার (গৃহিণী), ৪. শহীদুর রহমান সাজু (ব্যবসায়ী), ৫. জেবুন নাহার শিউলী (শিক্ষক), ৬. সাজ্জাদুর রহমান (ব্যাংকার), ৭. শফিকুর রহমান (ব্যবসায়ী) এবং ৮. শাহনাজ পারভীন শেলী (শিক্ষক)।
ছোট মেয়ে শাহনাজ পারভীন শেলীর বিয়েতে লুৎফর রহমান (সামনের সারিতে বাম থেকে দ্বিতীয়)
সন্তানদের মধ্যে শুধু বড় ছেলে সাইফুর রহমান রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি মারা যান। অন্য কেউ রাজনীতিতে যুক্ত হননি।
১. নাতি কাব্যর জন্মদিনে লুৎফর রহমান ও তাঁর স্ত্রী; ২. বড় নাতনি উম্মে জান্নাতুল ফেরদৌস এবং নাতনির মেয়ের সঙ্গে লুৎফর রহমান
প্রভাবশালী এমপির সংসারেও টানাটানি!
স্ত্রী এবং ৮ সন্তানের সঙ্গে লুৎফর রহমান
বঙ্গন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রভাবশালী এমপি এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য হওয়ার পরেও লুৎফর রহমানের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। তাঁর কাছে সংসারের চেয়ে দল ছিল বড়। কম বয়সে পিতৃহারা হয়েছিলেন বলে আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন ছিল না। জমিজমা যা ছিল, তা অন্য লোকেরা দেখাশোনা করতো। অন্যকে দিয়ে সাবানের কারখানা, কাপড়ের দোকান ইত্যাদি ব্যবসা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনোটিই তেমন লাভজনক হয়নি। অনেক সময় জমি বিক্রি করেও সংসার চালিয়েছেন, রাজনীতি করেছেন, দারিদ্রপীড়িত গাইবান্ধা এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
জেবুন নাহার শিউলীর ভাষ্য: ‘আব্বা এমপি থাকা অবস্থায়ও আমাদের ঘরে মাস শেষে টানাটানি পড়ে যেত।’ তিনি জানান, তিনি এবং তাঁর ভাই সাজ্জাদুর রহমান যখন ঢাকায় পড়াশোনা করতে যান, তখন তাঁরা এতটাই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হন যে, তিনি তাঁর বাবাকে বলেছিলেন, তোমার ছেলে মেয়ে কিংবা তোমার নিজের জন্য ঢাকায় একটা থাকার ব্যবস্থা করার কথা কি তোমার মনে হয়নি? লুৎফুর রহমান জবাব দিয়েছিলেন, ‘না মনে হয়নি।’ মেয়ে বললেন, ‘তাহলে সংসার না করলেই তো নির্বিঘ্নে রাজনীতি করতে পারতে।’ উত্তরে হেসে তিনি বললেন, ‘আমি তো সংসার করতে চাইনি। তোমার দাদা-নানা মিলে আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছেন।’
রাজনীতির কারণে সংসারে মনোযোগ দিতে পারেননি লুৎফর রহমান। ৮ সন্তানের পড়ালেখাসহ সংসারের যাবতীয় দেখভাল করতে হতো স্ত্রীকে। তারওপর দলের নেতাকর্মীদের আপ্যায়ন। শিউলি বলেন, ‘আব্বা অনেক সময় এটাও জানতেন না যে আমরা কে কোন ক্লাসে পড়ি। একটি ঘটনা এরকম: সাজ্জাদকে নিয়ে একবার তিনি গাইবান্ধা শহরের টাউন লাইব্রেরিতে যান। দোকানদারকে বলেন, শংকর, ক্লাস সেভেনের এক সেট বই দে। তখন সাজ্জাদ বললো, আব্বা আমি তো ক্লাস এইটে উঠেছি। আসলে আমাদের বাড়িতে পড়াশোনার কোনো পরিবেশ ছিল না। দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের এতোটা ভিড় লেগে থাকত যে, বাড়িতে পড়াশোনা করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার ছিলো।’
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যখন ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেয়া হয়, তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা গাইবান্ধায় এসে ডাকবাংলোর পাশাপাশি লুৎফর রহমানের বাড়িতে থাকতেন। সব মিলিয়ে এই বাড়িটি হয়ে ওঠে আরেকটি পার্টি অফিস। তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই লুৎফর রহমানের মতো একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের অতি সাধারণ বাড়িঘর দেখে বিস্মিত হতেন।
অসুস্থতা, মৃত্যু ও দাফন
রাজধানীর ধানমন্ডিতে লুৎফর রহমানের জানাজায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা
বার্ধক্য জনিত কারণে ২০০৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকাল ছয়টায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লুৎফর রহমান। শহীদুর রহমান সাজু বলেন, ‘আব্বা মৃত্যুর আগে খুব বেশি ভোগেননি। ন্যাম ভবনে অসুস্থ হয়ে পড়লে ছোট ভাই সাজ্জাদ এবং ভগ্নিপতি শাহ সুজা প্রধান তাঁকে ল্যাবএইডে ভর্তি করেন। নিয়মিত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. আবুল কাশেম খন্দকারের পরামর্শে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়। অবশ্য হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি হার্ট অ্যাটাক করেন।’ শহীদুর রহমান জানান, লুৎফর রহমানের মৃত্যু সংবাদ শুনে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা হাসপাতালে ছুটে আসেন।
২২ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এবং দুপুরে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় লুৎফর রহমানের দুটি জানাজা হয়। জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল হামিদ, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদসহ লুৎফর রহমানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা জানাজায় অংশ নেন।
ঢাকায় দুই দফা জানাজা শেষে সন্ধ্যায় লুৎফর রহমানের মরদেহ নেয়া হয় গাইবান্ধায়। শহরের পলাশপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তৃতীয় জানাজার পর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
জেবুন নাহার শিউলী বলেন: ‘আমাদের হয়তো অনেক না পাওয়া আছে। জীবন সংগ্রামের অনেক কাহিনী আছে। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে অমাদের কষ্ট, আমাদের পরিবার ও বাবার এত ত্যাগের কাহিনী কত জন জানে? বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম তো জানতেই পারলো না তাঁর ত্যাগের ইতিহাস। দৃশ্যমান কিছু থাকতেই পারতো, যা দেখে মানুষ বলতে পারতো এই সেই মানুষ, যিনি সমস্ত লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে নিজের জীবন, যৌবন ও পরিবারকে বঞ্চিত করে দেশের জন্য নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। আব্বা নিজের বিয়ের আংটিটাও দলের তহবিলে দিয়ে গেছেন।’
প্রসঙ্গত, পলাশপাড়া মোড়ে লুৎফর রহমানের বাড়ির সামনের রাস্তার মোড়ে তাঁর একটি নামফলক দেয়া হলেও জেবুন নাহার শিউলী বলেন, ‘এই ফলকটির অবস্থান এবং এটির অবস্থা এতই করুণ যে, এটা দেখলে বরং আমাদের কষ্ট হয়।’
##