বাংলাদেশে থাকতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের মেয়ে, কেন পারেননি?

মঞ্জুশ্রী দাশ (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১—১৯ মার্চ ১৯৯৫)

১৯৭২ সালে একবার এবং এরপরে দুয়েকবার জন্মভূমি বাংলাদেশে এসেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ। চাকরি নিয়ে এখানে বসবাস করতেও চেয়েছিলেন। বিশেষ করে রেডিওর বাংলা বিভাগে। কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি।

বরিশালে তাদের পৈত্রিক বাড়িতে (সর্বানন্দ ভবন) এখন যারা বসবাস করছেন, তারা বাড়িটা কিনেছেন বলে দাবি করলেও ১৯৯০ সালে কবি আল মাহমুদকে লেখা চিঠিতে মঞ্জুশ্রী উল্লেখ করেছেন, বরিশালের বাড়িটা বিক্রি হয়নি। জীবনানন্দের জন্য সেখানে একটি কালচারাল প্রতিষ্ঠান বা একাডেমি হলে তিনি খুশি হবেন। প্রশ্ন হলো, এখন বরিশালের বগুড়া রোডে জীবনানন্দের পৈত্রিক বাড়িতে যারা থাকেন, তারা ১৯৬০ সালে সালে বাড়িটা কিনেছেন দাবি করলে সেই তথ্য কি সঠিক নয়, নাকি মঞ্জুশ্রী বাড়ি বিক্রির তথ্যটি জানতেন না?

চিঠিতে বাংলাদেশে বসবাসের ব্যাকুলতা

মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন সম্পাদিত ম্যাগাজিন ‘উপমা’র আল মাহমুদ সংখ্যায় (২৬ মার্চ ১৯৯৪) আল মাহমুদকে লেখা মঞ্জুশ্রীর তিনটি প্রকাশিত হয়েছে। একটিতে তারিখ ১৬ মার্চ ১৯৭২ এবং আরেকটিতে ২৯ আগস্ট ১৯৯০। অন্য চিঠিতে তারিখ নেই। তবে চিঠির ভাষায় মনে হয় এটি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে কলতায় যাওয়ার পর আল মাহমুদকে লেখা দ্বিতীয় চিঠি।

বাংলাদেশে প্রথমবার এসেই যে কবি আল মাহমুদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে সেটি জানা যাচ্ছে ১৯৭২ সালের ১৬ মার্চ লেখা চিঠিতে। এতে তিনি লিখেছেন: ‘রূপসী বাংলার টুকরো ছবি নিয়ে পদ্মা/মেঘনার দেশ আমার কাছে স্বপ্নের মত হয়েছিল। মেঘনার কাছে যেসব বাসমতী আঘ্রান সেখানে কিছুদিন আঙ্গুল ঠেকেছিল মূঢ় রক্তের আঁজলায়। মানুষের অস্থি দিয়ে তৈরী হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাভাষা এখানে সবচেয়ে সমাদৃত।’

পদ্মা/মেঘনার দেশ তার অত্যন্ত প্রিয় উল্লেখ করে মঞ্জুশ্রী লিখেছেন, ‘কদিন এখানে খুব ভালো লেগেছে। আপনাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে- মনে হয়েছে- সহৃদয় মানুষ। আমি বাংলাদেশের মানুষ- এখানে থাকা সম্ভব হলে বড় ভাল হয়।’

চিঠিতে মঞ্জুশ্রী তার ঠিকানা লিখেছেন ১৭২/৩ রাসবিহারী এভিনিউ কলকাতা—যেটি তার কাকা অশোকানন্দ দাশের বাড়ি। যে বাড়িতে মৃত্যুর পরে জীবনানন্দের মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছিল। জীবনানন্দের বাড়ি এর অদূরেই ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডে (বর্তমান নাম শরৎ বসু রোড)। ১৯৫৫ সালে জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িটা ছেড়ে দেন তার স্ত্রী লাবণ্য দাশ। পরে তিনি দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলের বিভিন্ন বাসায় ভাড়া থেকেছেন। লাবণ্য মারা যান ১৯৭৪ সালে। তার মানে মঞ্জুশ্রী যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জন্মভূমিতে আসেন, তখনও লাবণ্য জীবিত। কিন্তু মায়ের সঙ্গে থাকেন না। ঠিকানা ব্যবহার করেছেন কাকার। এই সময়টায় লাবণ্য তাঁর অসুস্থ ছেলে সমরানন্দকে নিয়ে ভীষণ টানাপোড়েনের জীবন-যাপন করেছেন। সম্ভবত এ কারণে মঞ্জুশ্রী নিজের মতো থাকতে চেয়েছিলেন। শিক্ষকতাসহ নানা ধরনের কাজ করেছেন। কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারেননি।

মঞ্জুশ্রী যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছরই ঢাকায় এসেছিলেন, তার সাক্ষী বাংলাদেশ বেতারের মুখপত্র ‘বেতার বাংলা’র মার্চ ১৯৭২ (প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৭ ফাল্গুন ১৩৭৮) সংখ্যা। এতে মঞ্জুশ্রীর একটি ছবি প্রকাশিত হয়, যেখানে লেখা: কবি জীবনানন্দ দাসের কন্যা (দাশ বানানটি ভুল)। ইনি সম্প্রতি বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। বেতার বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়ে মঞ্জুশ্রী বাংলাদেশে আসেন। যেহেতু প্রথম সংখ্যায় তার খবর প্রকাশিত হয়নি, তার মানে ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ সপ্তাহের মধ্যে মঞ্জুশ্রী বাংলাদেশে আসেন বলে অনুমান করা যায়। তাছাড়া আল মাহমুদকে লেখা তাঁর প্রথম চিঠিতে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭২ সালের ১৬ মার্চ।

আল মাহমুদকে লেখা আরেকটি চিঠিতে তারিখ উল্লেখ না থাকলেও চিঠির ভাষায় মনে হয় এটিও বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার কিছুদিন পরে। সম্ভবত প্রথম সফরের পরে। চিঠিতে মঞ্জুশ্রী আল মাহমুদকে ‘মাহমুদ ভাই’ বলে সম্বোধন করে লিখেছেন: ‘এখানে এসে আপনাকে চিঠি দিয়েছি- পেয়েছেন হয়তো।’ তার মানে ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরে তিনি আরও একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তিনি হয়তো ১৯৭২ সালের ১৬ মার্চের চিঠির কথা লিখেছেন।

বাবা ও মায়ের সঙ্গে ছোট্ট মঞ্জুশ্রী (বাম থেকে দ্বিতীয়)

এতে বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চান বলে তিনি জানান। সঙ্গে এই দেশে কোনো কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না—সে বিষয়ে আবারও আল মাহমুদের সহযোগিতা চান। ঢাকা সফরে এসে গণকণ্ঠ পত্রিকার অফিসে (আল মাহমুদ তখন এই পত্রিকার সম্পাদক) গিয়েছিলেন। গণকণ্ঠের সবাইকে নমস্কার জানান চিঠিতে। এরপর কখনো ঢাকায় যাওয়া সম্ভব হলে আগে বৌদির (আল মাহমুদের স্ত্রী) কাছে যাওয়ার ইচ্ছাও ব্যক্ত করেন মঞ্জুশ্রী। এই চিঠিতেও নিজের ঠিকানা লিখেছেন ১৭২/৩ রাসবিহারী এভিনিউ।

এরপর এরপর ১৯৯০ সালের ২৯ আগস্ট আল মাহমুদকে লেখা আরও একটি চিঠিতে বাংলাদেশে বসবাসের জন্য মঞ্জুশ্রীর আকুলতা। সেইসঙ্গে একটি কাজের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন। আল মাহমুদকে ‘শ্রদ্ধাস্পদেষু’ বলে সম্বোধন করে লিখেছেন: ‘আপনি অসাধারণ মানবিক। তাই আমার বিপন্ন মুহূর্তের কিছু কথা জানাচ্ছি।’ মঞ্জুশ্রী জানান যে, তিনি তার বাবার (জীবনানন্দ দাশ) বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন। কিন্তু তার পরিবেশ পরিস্থিতি একেবারেই মসৃণ নয়। খুব কষ্ট করে গবেষণা করছেন। তার লেখায় ইংল্যান্ডের ২/৩ জন কবিকে নিয়ে আলোচনা আছে। কিন্তু বিদেশে যাওয়া ও থাকা সহজ নয়। অথচ লন্ডনে কিছুদিনের জন্যে যাওয়া একান্ত দরকার। প্রসঙ্গত, ড. প্রণবরঞ্জন ঘোষ এবং ড. উজ্জ্বল মজুমদারের নির্দেশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে মঞ্জুশ্রী এই গবেষণা করেন।

মঞ্জুশ্রী লিখেছেন: ‘সবচেয়ে ভালো হতো যদি লণ্ডনে বিবিসি বা বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ পেতাম। বিদেশে কোন রেডিও স্টেশনে বাংলা বিভাগে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কাজ হলে সবচেয়ে ভাল হোত।’ আল মাহমুদ যদি বিদেশে তার জন্য কিছু করতে পারেন তাহলে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হবেন বলেও জানান মঞ্জুশ্রী।

চিঠিতেই লিখেছেন: ‘বরিশালের বাড়ী বিক্রি করা হয়নি। এ বাড়িটি বগুড়া রোডে। অন্যেরা থাকে। বাবার জন্যে এ বাড়ীতে কোন কালচারাল প্রতিষ্ঠান বা আকাদেমী হলে ভাল হোত।’ সে বিষয় আর কোন আশা দেখেননি বা পাননি কোথাও থেকে।

এখানেও ঠিকানা লিখেছেন ৫৭/১৩ বালীগঞ্জ সার্কুলার রোড, কলকাতা। প্রযত্নে শ্রীযুক্তা বেলা সেন। প্রসঙ্গত, মঞ্জুশ্রী বালীগঞ্জের সাউথ পয়েন্ট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৯০ সালেও এই স্কুলে ছিলেন কি না, সেটি নিশ্চিত নয়। তবে হতে পারে, স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার্থে এর আশেপাশে তিনি বসবাস করতেন। শেষদিকে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে চাকরি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের একটা হাহাকার ছিল মনে।

প্রকাশ: ডেইলি স্টার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top