আপনাকে চারটি প্রশ্ন করা হচ্ছে: ১. আপনি কি ভাত খেয়েছেন? ২. আপনি কি ভাতের সঙ্গে মাছ খেয়েছেন? ৩. ভাত খাওয়ার পরে আপনি কি পানি খেয়েছেন? ৪. আপনি কি বোতলের পানি খেয়েছেন?
এবার এই চারটি প্রশ্নের উত্তরে আপনাকে যদি একটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলতে বলা হয়, দিতে পারবেন? যদি দুটি প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং দুটির উত্তর ‘না’ হয়, তাহলে আপনি একটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে উত্তর দেবেন কীভাবে?


জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ এবং গেজেট বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ওপর জনগণের মতামত নিতে এই গণভোট। জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য একটি ব্যালটের বাইরে গণভোটের জন্য একটি অতিরিক্ত ব্যালট পেপার দেওয়া হবে। সেখানে লেখা থাকবে: “আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?”
খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকার-সহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
পৃথিবীর কোনো দেশে কোনোদিন এই পদ্ধতিতে ভোট হয়েছে বলে মনে হয় না। ভোটাররা একটি ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোট দিয়ে চারটি ভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবে কীভাবে? ধরা যাক, কেউ দুটিতে ‘হ্যাঁ’ দেবে আর দুটিতে ‘না’। তাহলে সে কী করবে? ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ দুটি বাক্সেই ভোট দেবে? তাহলে তো ব্যালট পেপারটি বাতিল হয়ে যাবে।

জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পরে সেটি দেখাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
বস্তুত চারটি প্রশ্নের উত্তরে একটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের এই ধারণাটিই ত্রুটিপূর্ণ। শুধু তাই নয়, জুলাই সনদের ৮৪টি প্রস্তাব ও ৭টি অঙ্গীকারের ওপর গণভোটের ধারণাটিও অযৌক্তিক। কেননা, যে সনদের ওপর গণভোট হবে, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কতটা জানে? একজন সাধারণ কৃষক, গৃহিণী বা রিকশাচালক বা কম পড়লেখা জানা মানুষ জুলাই সনদের ভারী ভারী কথা পড়ে বুঝবে বা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কেউ তাদের বোঝাবে? এটি সম্ভব?
আপনি যেহেতু এই লেখাটি পড়তে পারছেন, গণভোটের চারটি প্রশ্নও পড়তে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের ভোটাররা কি শতভাগ পড়াশোনা করতে শিখে গেছে? নিশ্চয়ই না, তাহলে যারা পড়তে জানেন না, তাদেরকে সংবিধানবিষয়ক জুলাই সনদের ‘মহা-বিসিএস পরীক্ষা’র প্রশ্নপত্রটি কে বা কারা পড়ে দেবেন এবং উত্তর দিতে সহযোগিতা করবেন? ভুল উত্তর দিলে দায় কে নেবেন? মনে রাখা দরকার, বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, অধিকাংশ লোক ‘না’ ভোট দিলে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
তাছাড়া জুলাই সনদের মতো একটি বড় ডকুমেন্ট বা রাজনৈতিক দলিল—যার সবগুলো ধারা ও অঙ্গীকারে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি; অনেক প্রস্তাবেই বিএনপিসহ আরও একাধিক দল নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি দিয়েছে। সুতরাং যে দলিলের অনেকগুলো প্রস্তাবেই নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, তার ওপর সাধারণ মানুষ ভোট দেবে কী করে, সেই প্রশ্নের সুরাহাও হয়নি। বরং নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশ করেছে, সেটিও তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ। এখানে তারা স্পষ্টতই রাজনৈতিক দলগুলোকে উপেক্ষা করেছে।
পৃথিবীর অনেক দেশে সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে সংসদে অনুমোদনের পরে গণভোটের বিধান রয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়ন তথা সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে সংসদ গঠনের আগেই গণভোটের যে বিধান করা হয়েছে, এটি অযৌক্তিক।

জুলাই সনদ গণভোটে পাস হয়ে এলে নিম্নকক্ষে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচিত হয়ে এলেও পিআর পদ্ধতির ফলে উচ্চকক্ষে তাদের বিরোধীরাই প্রভাবক শক্তি হয়ে যেতে পারে সংখ্যানুপাতিক ভোটে। তাহলে সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সংকটে পড়তে পারে সরকারি দল।
অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে বারবার বলা হচ্ছে যে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতের ভিন্নতা ও বিরোধ পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল করছে। যদিও জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা দাবি করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতের পার্থক্য থাকলেও অনেক বিষয়েই তারা ঐকমত্যে আসতে পেরেছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত জুলাই সনদে সংবিধান বিষয়ক ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক অর্জন। প্রধান উপদেষ্টার ভাষায় কিছু প্রস্তাবে সামান্য ভিন্নমত আছে। বাকি অল্প কিছু প্রস্তাবে আপাতদৃষ্টে মনে হয় অনেক দূরত্ব আছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিক কিছু নয়।
প্রশ্ন হলো, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে কি ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠনের বিষয়ে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়েছে? যদি ‘না’ হয়, তাহলে সরকার এখন কীসের ভিত্তিতে বা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এরকম একটি বড় সিদ্ধান্ত নিল কেন?

