কিন্তু জুলাই সনদের যে খসড়া সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে এটিকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হচ্ছে।
পাঠকের মনে থাকবে, গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই এই অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি ওঠে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই অভ্যুত্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। কেননা, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই এই অভ্যুত্থানকে ‘মার্কিন অর্থায়নে জামায়াত-শিবিরের রাষ্ট্রবিরোধী কাজ’ হিসেবে দাবি করে আসছে। যে কারণে অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন—যারা পরবর্তীতে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং সেই ধারাবাহিকতায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) করলেন, তারা দ্রুত জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি করছিলেন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলিউশন’ বা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারির কর্মসূচিও দিয়েছিল। কিন্তু এর আগের রাতেই সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে।

জুলাই সনদ মূলত ওই ঘোষণাপত্রেরই ধারাবাহিকতা। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি অঙ্গীকার—যা পূরণে তারা বাধ্য থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো একটি ডকুমেন্ট তৈরি করে রাজনৈতিক দলগুলোকে তা মানতে বাধ্য করা যায় কি না বা যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়নি বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় সকল দল যেসব বিষয়ে একমত হয়নি, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে?
জুলাই ঘোষণাপত্রের যে খসড়াটি সংবাদমাধ্যমে এসেছে, সেখানে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।
প্রস্তাবিত জুলাই সনদে এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য করে এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে বিধান করা হয়েছে। এই বিধানটিও ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জড হতে পারে।
ভাষা, নাগরিকত্ব, সংবিধানের মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ৮৪টি বিষয় জুলাই সনদে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে সবগুলো বিষয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। প্রশ্ন হলো, ঐকমত্য না হওয়া বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন হবে কী করে?
নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন ছাড়া অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে। তাছাড়া কোনগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ, সেটি কে ঠিক করবে বা কীভাবে নির্ধারিত হবে?
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, সংস্কার কার্যক্রমের ভার তারা নির্বাচিত সংসদের হাতে ছেড়ে দেবেন না। বরং জুলাই সনদের ভিত্তিতেই আগামী সংসদ গঠিত হবে, গণপরিষদ গঠিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই জুলাই সনদ কার্যকর করতে হবে।
নাহিদ যদি মনে করেন যে নির্বাচিত সরকার সংস্কার ও সনদ বাস্তবায়ন করবে না, তাতে মনে হতে পারে, তিনি বা তারা হয়তো জানেন যে আগামীতে কারা সরকার গঠন করবে। যারা সরকার গঠন করবে বলে তারা ধারণা করছেন, তাদের ওপর এনসিপি ভরসা করতে পারছে না বা বিশ্বাস করছে না। কিন্তু নির্বাচিত সংসদের ওপর অনাস্থা মানে জনগণের ম্যান্ডেটকে অস্বীকার করা। তাছাড় অন্তর্বর্তী সরকারকেই যদি সংস্কার কার্যক্রম এবং জুলাই সনদে থাকা বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে কতদিন লাগবে এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি না? জুলাই সনদে যেসব সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, সেখানে সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত থাকা বিষয়গুলো একটি অনির্বাচিত সরকার সরকার কীভাবে করবে—সেটিও বড় প্রশ্ন।
ফলে জুলাই সনদকে যদি সংবিধানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে এখানে সকল দলকে যুক্ত করতে হবে। কেউ যদি যৌক্তিকভাবে আপত্তি জানায় এবং এতে স্বাক্ষর না করে, তাহলে এর পরিণতি কী হবে, সেটি বিরাট প্রশ্ন। একইভাবে পরবর্তী সংসদ এই সনদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি বলার এখতিয়ারও অন্তর্বর্তী সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। কারণ জনগণ যাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, জনগণ যাদেরকে দায়িত্ব দেবে, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তারা কোন কোন বিষয়ে একমত হবেন বা হবেন না, এই সময়ের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে সেটি বলার সুযোগ নেই। তবে এটা ঠিক, কিছু জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ছাড়া নির্বাচন এবং সরকার গঠিত হয়ে গেলে রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, সেটিও অর্জিত হবে না। ফলে জুলাই সনদ নিয়ে কী হবে, সে বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সুযোগ নেই।