এতিমখানার মডেলে গণমাধ্যম চলতে পারে না

বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি নিয়ে ‘প্রেস রাইটস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকার

১. আপনি কবে থেকে সাংবাদিকতা করছেন? কীভাবে এই পেশায় যুক্ত হলেন?

বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন আমার নিজের শহর ঝালকাঠিতে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেমন থিয়েটার, আবৃত্তি, সাহিত্যের ছোট কাগজ—ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ঝালকাঠি শহর থেকে তখন দুই তিনটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা (দৈনিক শতকণ্ঠ, আজানা বার্তা, অজানা খবর) প্রকাশিত হতো। এর মধ্যে শতকণ্ঠ পত্রিকায় মাঝেমধ্যে লিখতাম। বিশেষ করে ফিচার। ওই সময়ে তৃণমূল পর্যায়ের সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করতো ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (পরবর্তীকালে বন্ধ হয়ে যায়)। ২০০১ সালে তারা ঝালকাঠি শহরে একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সেই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের জন্য সাক্ষাৎকার দিলে আমি নির্বাচিত হই। ওই প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়েই জানতে পারি, অন্য যেকোনো লেখার সঙ্গে সংবাদ লেখার পার্থক্যগুলো। মূলত এতদিন যেভাবে লিখতাম, সেটি পুরোপুরি বদলে যায়। এমএমসির একটি পাক্ষিক পত্রিকা ছিল ‘মেঠোবার্তা’। যেটি প্রকাশিত হতো পটুয়াখালী থেকে। একেবারেই ভিন্নধর্মী কাগজ। সেখানে লেখার জন্য আমাকে বিভিন্ন ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হতো। খুবই আগ্রহের সাথে কাজগুলো করার চেষ্টা করি। কর্তৃপক্ষ আমার লেখার ধরন ও কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে আমাকে একটা ফেলোশিপ দেয়—যা আমার কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দেয়।

২০০২ সালের শুরুর দিকে জানতে পারি যে, প্রথম আলোর ঝালকাঠি প্রতিনিধি পরিবর্তন করা হবে। প্রথম আলো এমন একজন তরুণকে খুঁজছিল, যে সব সময় দৌড়ঝাপ করে কর্তৃপক্ষের চাহিদামাফিক সংবাদ পাঠাতে পারবে। সেইসাথে প্রথম আলোর সামাজিক সংগঠন ‘বন্ধুসভা’রও অনেক কাজ ছিল। আমি যেহেতু আগে থেকেই নানাবিধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় লিখছিলাম; লেখালেখির ব্যাপারে মোটামুটি একটা ধারণা ছিল—এসব কারণে প্রথম আলো আমাকে পছন্দ করে এবং এভাবে কাজটা শুরু করি। তারপর ২০০৫ সালে লেখাপড়া এবং আরও কিছু পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় ঢাকায় চলে আসি এবং ২০০৬ সালের এপ্রিলে যোগ দিই প্রকাশের পথে থাকা দৈনিক যায়যায়দিনে (প্রকাশকাল ০৬ জুন ২০০৬)। বলা যায় শুরুটা এভাবেই।

২. সাংবাদিকতা জীবনের সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং সময় কোনটি ছিল? কেন সেটি চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন?

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা প্রতিনিয়তই চ্যালেঞ্জিং। যখন মাঠের রিপোর্টার ছিলাম তখন চ্যালেঞ্জ ছিল একরকম। সেটা যতটা না চ্যালেঞ্জ তার চেয়ে বেশি ঝুঁকি। যেমন, ২০০৭ সালের নভেম্বরে উপকূলে যখন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে, তখন টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় উপদ্রুত এলাকায় ঘুরে ঘুরে রিপোর্ট করেছি। বিধ্বস্ত যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ নেই, রাতে থাকার জায়গার সংকট, খাবারও মনমতো হয় না—এসব মাথায় নিয়ে কাজ করেছি। ওটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সেইসাথে দারুণ এক্সাইটিংও ছিল। মনে আছে তখন একটানা বেশ কয়েকদিন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে আমি ছিলাম। একদিনে দুই তিনটা প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। এখনও ওই স্মৃতি বেশ আলোড়িত করে। কষ্টের সাথে সাথে মনে হয় আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজটা করেছি ওই সময়ে।

২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের সময় কাজ করতাম এবিসি রেডিওতে। আমাদের আরও দুই তিনজন সহকর্মীর মতো আমাকেও ওই ঘটনা কাভার করতে হয়েছে। ওটা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

মাঠের রিপোর্টিং ছেড়ে যখন টেলিভিশনের নিউজ এডিটর হলাম, তখন নিত্য-নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। বিশেষ করে টেলিভিশনের ব্রেকিং কোনটা হবে, কোনটা হবে না। স্ক্রলে কোনটা সিঙ্গেল যাবে কোনটা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ ট্রিটমেন্ট কেমন হবে; শিরোনামের ভাষা কী হবে; বুলেটিনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় অংশে প্রধানমন্ত্রীর খবর দিলে উপর থেকে চাপ আসবে কি না; বিরোধী দলের (বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত) খবরের ট্রিটমেন্ট কেমন হবে বা কতটুকু ট্রিটমেন্ট দিলে সরকার গোস্বা হবে; টকশোতে কাকে ডাকা যাবে বা যাবে না; টকশোয়ের গেস্টদের কেউ যদি অতিমাত্রায় সরকারবিরোধী কথা বলেন তাহলে তার প্রভাব কী হবে; বিভিন্ন স্পর্শকাতর ইস্যুতে সংবাদের ভাষা, টকশোয়ের অতিথি নির্বাচন এবং তার সঙ্গে আলাপের কনটেন্ট ইত্যাদি নিয়ে ভীষণরকম চিন্তিত থাকতে হতো।

২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাতে যখন হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা হয়, তখন আমি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে কাজ করি। সারা রাত ওই ঘটনা আমরা স্পট থেকে লাইভ বা কখনো অ্যাজলাইভ প্রচার করি। প্রতিনিয়তই নানারকম চাপ আসছিল। এই ধরনের ঘটনা কাভার করার অভিজ্ঞতা যেহেতু আমাদের ছিল না, ফলে এটা দারুণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। ঝুঁকিপূর্ণও ছিল। এর আগেও সংবাদের প্রয়োজনে সারারাত নিউজরুমে থাকা এবং নির্ঘুম রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা থাকলেও হোলি আর্টিজানের ঘটনা চলাকালীন নিউজরুমের বাস্তবতা বলে বোঝানো যাবে না। ওই ঘটনা নিয়ে পরে আমি ‘গণমাধ্যমের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা’শিরোনামে একটা কলাম লিখেছিলাম—যেটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ২০১৭ সালে প্রকাশিত আমার ‘জঙ্গিবাদ গণতন্ত্র আইনের শাসন’ বইতে।

৩. বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পরিবেশের পরিবর্তন কি আপনার নজরে পড়েছে? গত এক দশকে কী ধরনের পরিবর্তন আপনি দেখতে পেলেন?

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন—যেটা বিকশিত হতে শুরু হয়েছে এই শতাব্দীর শুরুর দিকে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি। আমি যখন ঝালকাঠি শহরে সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন ফ্যাক্সের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি নিজেও কিছুদিন সংবাদ হাতে লিখে বা কম্পিউটার কম্পোজ করে ফ্যাক্সে সেটা প্রথম আলোর ঢাকা অফিসে পাঠিয়েছি। বিশেষ প্রতিবেদন বা ফিচার ও ছবি পাঠাতাম কুরিয়ারে। কিন্তু এটা আমাকে বেশিদিন করতে হয়নি। দ্রুতই কম্পিউটারে লিখে ই-মেইলে পাঠানো শুরু করি। শুরুর দিকে আমার মোবাইল ফোন ছিল না। ফলে প্রথম আলোর ঢাকা অফিস থেকে আব্বার ফোনে কল আসতো। এটা একটা বিব্রতকর ব্যাপার ছিল। ফলে দ্রুতই আমাকে একটা ফোন কিনতে হয়। এগুলো এই শতাব্দীর শুরুর দিকের ঘটনা। অনেকের কাছে এখন এগুলো গল্পই মনে হবে।

অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিকাশ এত দ্রুত হয়েছে যে, এটাকে আমার কাছে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন মনে হয়। এটা সম্ভব হয়েছে স্মার্টফোনের দাম সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসা এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে। তবে মুদ্রার অন্যপিঠ হলো, এই সুযোগে সাংবাদিকতার নামে প্রচুর অপেশাদার অনলাইন পোর্টাল ও অনলাইন টেলিভিশন চ্যানেল চালু হয়েছে—যা মূলধারার সাংবাদিকতাকে অনেক সময় প্রশ্নের মুখে ফেলছে। সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।

বেসরকারি টেলিভিশনের বিকাশ গত দুই দশকের সাংবাদিকতায় নিঃসন্দেহে একটা বড় পরিবর্তন।

এই সময়কালে সাংবাদিকতায় একটা বড় পরিবর্তন এনেছে ফেসবুক। এখন মানুষ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের আগেই অনেক খবর ফেসবুকে পেয়ে যায়। অনেক সময় সেখানে ভুল ও বিভ্রান্তিকর সংবাদও থাকে। কিন্তু তারপরও মানুষের তথ্য জানা এখন আগের চেয়ে সহজ। আবার তথ্য গোপন করে রাখাও এখন আগের চেয়ে কঠিন। কেননা অনেক গোপনীয় ঘটনাও কারো না কারো মোবাইল ফোনে হয়তো ধরা পড়ে—যা প্রকাশিত হয়ে যায়।

মোবাইল জার্নালিজম (মোজো) একটা বড় অগ্রগতি। এর মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা সহজ হয়েছে। সেইসাথে পেশাদারির সংকটও তীব্র হচ্ছে। সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাংবাদিকতায় ইতি ও নেতি—সব ধরনের পরিবর্তনই এসেছে।

আরেকটা পরিবর্তন আমার কাছে মনে হয়, সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লেও এর প্রভাব ও মর্যাদা কমেছে। দুই দশক আগেও ঝালকাঠির মতো ছোট্ট জেলা শহরে বসে সাংবাদিক হিসেবে যে মর্যাদা পেতাম, একটা সিঙ্গেল কলাম সংবাদেরও যে ইমপ্যাক্ট দেখেছি, সেটা এখন নেই। এখন অনেক বড় বিষয়ে পত্রিকার লিড সংবাদও অনেক সময় সেরকম ইমপ্যাক্ট ফেলে না। কারণ সংবাদ জানার উৎস ও সংখ্যা বেড়েছে। কোন পত্রিকায় কী ছাপা হচ্ছে, তা মানুষ সেভাবে খেয়াল করে না। বাসায় পত্রিকা রাখার প্রবণতাও কমে গেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাংবাদিকতার একটা ভয়াবহ প্রবণতা হলো ‘ভাইরাল জার্নালিজম’। যে সংবাদটি সোশ্যাল মিডিয়ায় যত ভাইরাল হয়, সেটা তত বেশি ‘সফল’। সোশ্যাল মিডিয়ায় চরিত্র হলো, সেখানে ভালো জিনিসের চেয়ে খারাপ জিনিত দ্রুত ছড়ায়। আর এখন মূলধারার টেলিভিশন ও পত্রিকাগুলোও ডিজিটাল প্লাটফর্ম থেকে অনেক বেশি আয় করতে চায় বলে ভাইরাল নিউজ ও কনটেন্টের ব্যাপারে বেশি মনোযোগী। ফলে অনেক সময় কোয়ালিটি জার্নালিজম এখানে মার খাচ্ছে। সাংবাদিকতায় প্রফেশনালিজম থাকছে না।

৪. আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব?

না। বাংলা ট্রিবিউনে ২০২৫ সালের ৩ মে একটা কলাম লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল: ‘মুক্ত গণমাধ্যমের ধারণাটিই ত্রুটিপূর্ণ।’ আমার মতে, গণমাধ্যম কখনও মুক্ত হয় না। মুক্ত হতে পারে না। তবে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তার ভেতরে থাকে। গণমাধ্যম সব আমলেই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে শৃঙ্খলিত থাকে। গণমাধ্যম আইনত স্বাধীন। কিন্তু তার নাটাই ধরা থাকে রাষ্ট্রীয় বিবিধ আইন-কানুন, নীতিমালা ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর বিধিবর্হ্ভিূত আচরণের হাতে। কার সংবাদ প্রচার করা যাবে বা যাবে না; কোন সংবাদের ট্রিটমেন্ট কেমন হবে; কোন সংবাদটি ‘কিল’ (ব্ল্যাকআউট) করতে হবে; কোন ব্যক্তিকে টকশোতে আনা যাবে না ইত্যাদি নানাবিধ প্রেসক্রিপশন মেনে চলতে হয় গণমাধ্যম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের।

বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রধান অন্তরায় হলো সাংবাদিকের পেশাগত অনিশ্চয়তা। যে মানুষটি জানেন না আগামী মাসে তার বেতন কবে হবে বা তিনি তার পাওনাটুকু কবে বুঝে পাবেন; যে মানুষটি জানেন না আগামী মাসে তার চাকরিটা থাকবে কিনা এবং চাকরি চলে গেলে তিনি তার পরের মাসে আরেকটা চাকরি পাবেন কিনা, তার কাছে আপনি যখন সাহসী, বস্তুনিষ্ঠ, নির্মোহ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করেন কীভাবে? সে কারণেই বলেছি, বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যমের ধারণাটিই ত্রুটিপূর্ণ। মুক্ত গণমাধ্যম পেতে চাইলে আগে সাংবাদিকের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। রাষ্ট্রকে সেরকম একটি পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এখন পর্যন্ত সংবাদপত্রের সাংবাদিকের জন্য ওয়েজবোর্ড বা বেতন কাঠামোটিই ঠিকমতো মানানো যায়নি। উপরন্তু টেলিভিশন এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য ওয়েজবোর্ড বলে কোনও শব্দই নেই। ফলে এরকম একটি বাস্তবতার ভেতরে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করা অত্যন্ত কঠিন।

৫. স্বাধীন সাংবাদিকতা রক্ষা করতে হলে কাঠামোগত কী কী পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন?

স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ভয় ও চাপমুক্ত কর্মপরিবেশ। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন হতে হবে স্বাধীন সাংবাদিকতার সহায়ক। সরকার, তার বিভিন্ন এজেন্সি ও ক্ষমতাসীন দল যদি গণমাধ্যমের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, তাহলে সেখানে স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে অধিকাংশ গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের কোনো বিজনেস মডেল নেই্। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণত মিডিয়া হাউজগুলো গড়ে তোলা হয় মালিকপক্ষের অন্যান্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান সুরক্ষার স্বার্থে। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মিডিয়াপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা নেওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে চলে, সেখানে যেরকম আর্থিক ও পেশাগত নিশ্চয়তা থাকে, তাদের মিডিয়া হাউজগুলোয় সেটা অনুপস্থিত। অনেকে ধরেই নেন, মিডিয়া হাউজগুলো এভাবেই চলে। এই পারসেপশনের কারণে অধিকাংশ গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানই পেশাদার হিসেবে গড়ে ওঠেনি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যবসা-সফল হয়নি। সুতরাং রাষ্ট্রকে এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে একটি মিডিয়া হাউজ গড়ে তোলার আগে তার বিজনেস মডেল দেখানো বাধ্যতামূলক থাকবে। কেউ যদি চ্যারিটি বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মিডিয়া গড়ে তোলেন, সেখানেও তার কর্মীদের সুরক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। এতিমখানার মডেলে কোনো গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।

টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়া হয় মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং এখানে মোটা অঙ্কের ঘুষের লেনদেন হয়। রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে এই ধরনের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না।

পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালের নিবন্ধ পেতেও সব সময় রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ‘ক্লিয়ারেন্স’ দেওয়ার নামে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেয়। দিনের পর দিন ঘুরায়। হয়রারি করে। তার আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ফাইল অনুমোদনের জন্যও ঘুষ দিতে হয়। অর্থাৎ গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সিং প্রক্রিয়াটিই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। এখানে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপনের বাজারে বিরাট সিন্ডিকেট আছে। কয়েকটি গ্রুপ এটা নিয়ন্ত্রণ করে। এটা ভাঙতে হবে এবং এক্ষেত্রে মূল কাজ সরকারের।

টেলিভিশন বিজ্ঞাপন নির্ভর করে ‘টিআরপি’ নামে একটি অদ্ভুত ও হাস্যকর পদ্ধতির ওপরে। প্রায় ২০ কোটি মানুষের দেশে কয়েকশো ডিভাইস দিয়ে টিভি ও অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয়। এটা কোনো অর্থেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। সুতরাং ক্যাবল অপারেটরদের এক বছরের সময় বেঁধে দিয়ে ডিজিটালাইজেশনের নির্দেশ দিতে হবে। ক্যাবল অপারেটরগুলো ডিজিটালাইজেশন হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্যাবল গ্রাহকের কাছ থেকে যে অর্থ আদায় করে, এর ২৫ শতাংশ মাসিক ভিত্তিতে দেশে চালু চ্যানেলগুলোকে সমহারে বণ্টন করবে—এরকম সুপারিশ গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও আছে।

সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টনে দুর্নীতি একটি বড় বাধা। বিশেষ করে ডিএফপি সংবাদপত্রের যে অবিশ্বাস্য প্রচারসংখ্যা প্রকাশ করে, সেটি বন্ধ করা জরুরি। এমন পদ্ধতি বের করতে হবে যাতে কেউ চাইলেও ঘুষ নিয়ে মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত প্রচারসংখ্যা বলতে না পারে। ইন্টারনেট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে এটা কঠিন কাজ নয়।

অনলাইন পোর্টালের নিয়ন্ত্রণহীন ও বিশৃঙ্খল প্রসার বন্ধ করার বিষয়ে গণমাধ্যম কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে, যেমন এর নিবন্ধন নীতিমালা পর্যালোচনা করে সেটিকে বাস্তবানুগ এবং কার্যোপযোগী করা; অনলাইন পোর্টালগুলো নিবন্ধন পাওয়ার পর তার বার্ষিক নবায়ন পদ্ধতি বাতিল করা; অনলাইন নীতিমালায় আইপিটিভি এবং অনলাইন পোর্টালে সংবাদ বুলেটিন সম্প্রচার করা যাবে না—এমন নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা; অনলাইন পোর্টালে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার আলোকে সরকারি বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা; নিবন্ধনহীন পোর্টালগুলো বন্ধের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা কার্যকর করা ইত্যাদি বাস্তবায়নে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।

৬. একটি প্রতিবেদনের বায়াসড কিনা, সেটি কীভাবে আপনি নির্ধারণ করেন? আপনার অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলা হয়, একজন সাধারণ পাঠককে আপনি বলবেন- কোন রিপোর্টটি তিনি বিশ্বাস করবেন আর কোন রিপোর্টকে তিনি সন্দেহ করবেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একজন পাঠককে কি যাচাই করতে হবে?

কোন প্রতিবেদনটি বায়াসড, সেটা একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে যাচাই করা কঠিন। সাংবাদিক হিসেবে আমিও যে সব সময় এটা চট করে বুঝি, সেই দাবিও করব না। অনেক খবরের পেছনের গল্পই আমরা জানি না বা পরে জানতে পারি।

গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের নানাবিধ স্বার্থ থাকে। প্রধানত ব্যবসায়িক স্বার্থ। ফলে অনেক সংবাদের পেছনে এই স্বার্থ কাজ করে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক সময় এমন সব সংবাদ প্রকাশিত হয়, যেসব পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়, সেগুলো চট করে একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে অবিশ্বাস করা বা সন্দেহ করা কঠিন। এসব ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় সংবাদের ভাষা ও ট্রিটমেন্ট এবং কোন পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদটি প্রচারিত হলো—সেটি খেয়াল করি। যদি নির্দিষ্ট কোনো পক্ষকে টার্গেট করা হয়, তাহলে সেখানে সন্দেহ তৈরি হয়। চটকদার শিরোনামের খবরগুলো নিয়ে সব সময় সন্দেহ পোষণ করা উচিত। কোনো একটি গ্রুপের মালিকানাধীন সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল যদি আরেকটি গ্রুপের বিরুদ্ধে সংবাদ করে, সেখানে ওই সংবাদের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করা উচিত। এই সন্দেহ সব সময় সত্য নাও হতে পারে। অনেক সময় খবরটি সঠিক হতে পারে। কিন্তু সংবাদের ভাষা এবং তাতে ব্যবহৃত সূত্রের মাধ্যমে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব।

খবরের সত্যতা যাচাইয়ে এখন অনেক উপায় আছে। কিন্তু সাধারণ পাঠক এভাবে খবরের সত্যতা যাচাই করে সংবাদ পড়বে বা বিশ্লেষণ করবে, এটা বাস্তবসম্মত নয়। তবে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরের ওপর পাঠক-দর্শকের আস্থা বেশি এবং এই ধরনের গণমাধ্যম কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের চেষ্টা করে। ফলে ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টাল, পরীক্ষিত নয় এমন সংবাদপত্র ও অনলাইন টেলিভিশনের সংবাদ বিশ্বাস করার আগে একই বিষয়ে মূলধারার অন্য কোনো গণমাধ্যমে খবরটি এসেছে কি না, সেটা যাচাই করে দেখা যেতে পারে।

সংবাদটি বায়াসড বা পক্ষপাতমূলক কি না, সেটা যাচাইয়ের জন্য খবরের শিরোনামের ভাষা খেয়াল করা দরকার। সেখানে যদি উস্কানিমূলক, অতিরঞ্জিত বা আবেগপ্রবণ শব্দ বেশি থাকে, তাহলে সেটি বায়াসড হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্রতিবেদনটিতে একাধিক পক্ষ বা মতামতের প্রতিনিধিত্ব আছে কি না, সেটি দেখা দরকার। প্রতিবেদনটি কি তথ্য দিচ্ছে নাকি সাংবাদিকের নিজস্ব মতামত, সেটি দেখেও বোঝা যায় এটি বায়াসড কি না। কোন ঘটনাটি সংবাদে এসেছে এবং কোন ঘটনাটি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে—এটিও গুরুত্বপূর্ণ। খবরে ব্যবহৃত ছবি কতটা প্রাসঙ্গিক এবং ছবিটা আসল নাকি সম্পাদিত (বিকৃত)—সেটিও খবরের বিশ্বাসযোগ্য বোঝার একটি উপায় হতে পারে। খবরে কোনো একটি পক্ষকে অতিমাত্রায় বিশেষায়িত এবং কোনো পক্ষকে অতিমাত্রায় ভিলেন বানানোর চেষ্টা করা হলে বুঝতে হবে এটা বায়াসড।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। গ্যাস সরবরাহ নিয়ে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বললো পেট্রোবাংলা—একাধিক গণমাধ্যমে এরকম একটি খবর প্রকাশিত হয় মে মাসের শেষদিকে। এই খবরটি প্রকাশিত হওয়ার একদিন আগেই দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, শিল্প-কারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। ফলে অর্ধেকের বেশি কারখান বন্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে। এই সংবাদটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা শুরু হলে পেট্রোবাংলা গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দেয়।

এই খবরটি বায়াসড বা পক্ষপাতমূলক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ পেট্রোবাংলা বিবৃতিটি দিয়েছে ব্যবসায়ীদের একটি সংবাদ সম্মেলনের পরে। অর্থাৎ এটি আত্মপক্ষ সমর্থন। পেট্রোবাংলা শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহের যেসব পরিসংখ্যান দিয়েছে, সেগুলো একপাক্ষিক। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান নিয়ে বরাবরই সাধারণ মানুষের মনে সংশয় থাকে। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিসংখ্যান তৈরি করে মূলত নিজেদের সুবিধার্থে।  গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি মূলত পেট্রোবাংলার প্রেস বিজ্ঞপ্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ব্যবসায়ীদের কোনো বক্তব্য নেই। অর্থাৎ এটি একপাক্ষিত প্রতিবেদন। অতএব এটি বায়াসড হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

৭. বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় কি বায়াসড রিপোর্টিং হয়? যদি হয়ে থাকে কেন হয়? এখান থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

সম্ভবত সারা পৃথিবীতেই কমবেশি বায়াসড রিপোর্টিং হয়। এটা হয় নানা কারণে। প্রথমত গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের মালিকের স্বার্থে। দ্বিতীয়ত, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের চাপে। তৃতীয়ত সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের সম্পাদক বা নীতিনির্ধারক কিংবা সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের ব্যক্তিগত সুবিধার কারণে। চতুর্থত, কারো কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে। পঞ্চমত, বিজ্ঞাপনদাতা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুরোধ। এরকম আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন। তবে সাংবাদিকতায় পেশাদারির চর্চা বেশি হলে তথা সাংবাদিকদের পেশাগত নিশ্চয়তা বাড়ানো গেলে এবং গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রের চাপ কমানো গেলে—বায়াসড রিপোর্টিং কমিয়ে আনা সম্ভব।

৮. শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। তারা গণমাধ্যমের জন্য একটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। তারা একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সংস্কার প্রস্তাবটি কতটা সমসাময়িক? এ বিষয়ে বিস্তারিত আপনার যুক্তি-তর্কগুলো জানাবেন?

গণমাধ্যম কমিশনের সুপারিশগুলো সুন্দর এবং আইডিয়ালিস্টিক। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় অনেক সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য নয়। যেমন সাংবাদিকদের স্থায়ী চাকরির শুরুতে সরকারি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তাদের মূল বেতনের সমান বেতন ধার্য করার সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রশ্ন হলো, কয়টি গণমাধ্যমের পক্ষে এটা মানা সম্ভব? চাকরির শুরুতেই প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মূল বেতনের সমান বেতন তো দূরে থাক, হাতেগোণা কিছু প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে তো নিয়মিত বেতনই হয় না।

সাংবাদিককে ভালো বেতন দিতে হলে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানকে ভালো আয় করতে হবে। আপনি বলে দিলেন যে, প্রতিদিন দুট ডিম ও এক গ্লাস দুধ খাবেন। কিন্তু ডিম ও দুধ কেনার পয়সাটা কোথা থেকে আসবে, সেটি যদি না বলে দেন বা সেই ডিম ও দুধ কেনার মতো পরিবেশ যদি আপনি ঠিক না করে না দেন, তাহলে ওই পরামর্শের কোনো মানে নেই। পরামর্শ আমিও অনেক দিতে পারি। কারণ বুদ্ধি দিতে পয়সা লাগে না।

গণমাধ্যমে কালোটাকার অনুপ্রবেশ নিরুৎসাহিত করতে প্রতি বছর গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক হিসাব উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেছে কমিশন। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরাট অংশেই যে বিনিয়োগ হয়েছে, তা মূলত কালো টাকা। সুতরাং, মিডিয়ায় কালো টাকায় অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে গেলে শেষমেষ কতটি গণমাধ্যম টিকবে, সেটি বিরাট প্রশ্ন।

তবে কমিশনের অনেক ভালো পরামর্শ আছে—যেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেমন অনলাইন পোর্টালের নিয়ন্ত্রণহীন ও বিশৃঙ্খল প্রসার বন্ধ করতে কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। যেমন এর নিবন্ধন নীতিমালা পর্যালোচনা করে সেটিকে বাস্তবানুগ এবং কার্যোপযোগী করা; অনলাইন পোর্টালগুলো নিবন্ধন পাওয়ার পর তার বার্ষিক নবায়ন পদ্ধতি বাতিল করা; অনলাইন নীতিমালায় আইপিটিভি এবং অনলাইন পোর্টালে সংবাদ বুলেটিন সম্প্রচার করা যাবে না—এমন নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা; অনলাইন পোর্টালে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার আলোকে সরকারি বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা; নিবন্ধনহীন পোর্টালগুলো বন্ধের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা কার্যকর করা ইত্যাদি।

ফৌজদারি মানহানির সব আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, আদালত অবমাননা আইন, তথ্য অধিকার আইনের যেসব ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলো বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন। এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

সরকারি কোনো ঘোষণা ও বিজ্ঞাপন টেলিভিশনে প্রচারের ক্ষেত্রে ফি প্রদান করতে হবে; সরকার ক্যাবল অপারেটরদের এক বছরের সময় বেঁধে দিয়ে ডিজিটালাইজেশনের নির্দেশ দেবে; ক্যাবল অপারেটরগুলো ডিজিটালাইজেশন হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্যাবল গ্রাহকের কাছ থেকে যে অর্থ আদায় করে, এর ২৫ শতাংশ মাসিক ভিত্তিতে দেশে চালু চ্যানেলগুলোকে সমহারে বণ্টন করবে—এরকম সুপারিশগুলোও বেশ ইতিবাচক এবং এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।

এরকম আরও অনেক যৌক্তিক ও সময়োপযোগী সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন নির্ভর করছে গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের আন্তরিকতার ওপর। বিশেষ করে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নোয়াব এবং টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো এইসব সুপারিশের বিষয়ে একমত না হলে এগুলোর বাস্তবায়ন অসম্ভব।

৯. শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাংবাদিকতার অবস্থানকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

শেখ হাসিনার পতনের পরে গণমাধ্যমের কয়েকটি পরিবর্তন বেশ দৃশ্যমান। যেমন, আগে যে দলের (জামায়াতে ইসলামী) সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে ওপর একধরনের চাপ ছিল বা গণমাধ্যম নিজেই যে দলের সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে একধরনের স্বনিয়ন্ত্রণ আরোপ করতো, এখন সেই দলের সংবাদ অনেক বেশি গুরুত্বে সাথে প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো গণমাধ্যমে এই দলের সংবাদ প্রচারে অতি উৎসাহও লক্ষণীয়।

আগে টেলিভিশনের টকশোতে যাদের নিয়মিত দেখা যেতো, এখন তাদের অধিকাংশই অনুপস্থিত। টেলিভিশনের টকশোগুলোতে এখন নতুন কিছু মুখ যুক্ত হয়েছেন। বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির নেতারা এখন অনেক বেশি টকশোয়ের অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ পাচ্ছেন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও বাপক রদবদল হয়েছে। দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত তথা সমর্থকরা অনেকগুলো গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন। অতীতের সরকারের সুবিধাভোগী এমন অভিযোগে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ আখ্যা দিয়ে অনেক সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়ায় তারা আত্মগোপনে আছেন। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদেরও বিরাট অংশ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন—এমন ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে ঘটেনি।

প্রধান উপদেষ্টা এবং তার প্রেস সচিব (যিনি নিজেও একসময় একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাজ করতেন) যদিও বারবার বলছেন যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন ইতিহাসের সবচেয়ে স্বাধীনতা সময় পার করছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন ফেসবুকের কোনো একটি গ্রুপে একটা পোস্ট দিলেই একসাথে চারজন সাংবাদিদের চাকরি চলে যায়। এই পরিস্থিতি অতীতে কখনো বাংলাদেশের মানুষ দেখেনি। একসাথে দেশের কয়েকশো সাংবাদিক হত্যা মামলার আসামি। এই ঘটনা বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের ইহিাসে কখনো ঘটেছে কি না সন্দেহ আছে। সরকার বলছে যে এই ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ঠিক যে সরকার সরাসরি এই মামলাগুলো দায়ের করেনি বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা মব তৈরি করেছে, তাদেরকে সরকার উৎসাহ দেয়নি। কিন্তু যারা এসব মামলা দিয়েছে বা যারা মব তৈরি করেছে, তাদের অনেকেই সরকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বা পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা এখন রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান। কিন্তু এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে সরকারের শক্ত পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

গত বছরের ৫ আগস্টের পরে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, এখন ফেসবুকে কেউ একটা কর্মসূচি ঘোষণা করলেই দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানটিও ভয় পেয়ে যায় এবং তার নিরাপত্তার জন্য অফিসের নিচে শুধু পুলিশ না, সেনাবাহিনীও মোতায়েন করতে হয়! যারা ভয় দেখাচ্ছেন তারা হয়তো নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীও নন। কিন্তু তারা রাজনৈতিক দলের চেয়েও ক্ষমতাবান। কখনও মনে হতে পারে তারা বুঝি রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর। সম্প্রতি তিনটি বেসরকারি টেলিভিশনের চার জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে শুধুমাত্র ফেসবুকের একটি পেইজে হুমকি দেওয়ার কারণে। সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় যদিও বলেছে যে, ওই সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি পেছনে তাদের কোনও হাত নেই। কিন্তু যাদের হাত আছে, তাদের হাত সরকারের চেয়েও বড় কিনা, এই প্রশ্নও জনমনে আছে।

সাংবাদিকতা আগেও নানাবিধ চাপের মধ্যে ছিল। তবে সেই চাপ ছিল প্রধানত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পরে গণমাধ্যমের ওপর প্রধান চাপ বা ভীতির নাম মব। অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছ থেকে সংঘবদ্ধ আক্রমণই এখন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ভয়ের মধ্যে রাখছে। অর্থাৎ সরকার নিজে সরাসরি কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বা গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, ভয় দেখাচ্ছে না, কিন্তু সেই কাজটি করছে সরকারঘনিষ্ঠ বিভিন্ন গ্রুপ। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেইন করে বা পোস্ট দিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে যে, সংবাদমাধ্যমগুলো এখন ওই মবের ভয়ে তটস্থ থাকে। দেশের সবচেয়ে জনিপ্রয় ও প্রভাবশালী দুটি সংবাদপত্রের কার্যালয়ের নিরাপত্তায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের মতো ঘটনাই বলে দেয় এই মুহূর্তে দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কী হাল!

গত বছরের ৫ আগস্টের পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানে আক্রমণ হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ, তারা হাসিনা সরকারকে সমর্থন করেছে। সব আমলেই গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ছিল যে তারা সরকারকে সমর্থন দেয়।

গণমাধ্যম যতক্ষণ না নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে, যতক্ষণ না দেশে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল রাজনীতির চর্চা হচ্ছে, যক্ষণ না রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের একক খবরদারি বা নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হচ্ছে, যতক্ষণ না গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা নিজেদের আর দশটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা বন্ধ করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত গণমাধ্যম সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বা দিয়েছে—এই অভিযোগ থাকবে।

প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কি গণমাধ্যম নির্ভয়ে সবকিছু প্রচার ও প্রকাশ করতে পারছে? এখনও কি গণমাধ্যম এই সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে না? সুতরাং সরকারকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে গণমাধ্যম কি তখনও আক্রমণের শিকার হবে?

১০. সাংবাদিকতার মান বাড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ আমাদের অত্যন্ত জরুরি?

প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। শুরুতেই বলেছি যে, ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টারের প্রশিক্ষণের পরে আমার লেখালেখির ধরন বদলে যায়। এখন পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোয় সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ানো হয়। ফলে সাংবাদিকতায় পড়ালেখা করে যারা সাংবাদিকতায় আসেন, তাদের এই পেশায় ভালো করার সুযোগ বেশি। যদিও পেশাগত অনিশ্চয়তার কারণে অনেকেই এখন আর সাংবাদিকতায় আগ্রহী হচ্ছেন না।

সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন প্রচুর গুজব, ভুল ও অপতথ্যের ছড়াছড়ি। ফলে ফ্যাক্ট চেকিং জানা দরকার। সব গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানে ফ্যাক্ট চেকিং টুল থাকা দরকার। এ বিষয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।

প্রযুক্তির ভালো দিকগুলো সাংবাদিকতার দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করা দরকার। এআইয়ের যৌক্তিক ব্যবহার বাড়ানো দরকার। তবে মনে রাখতে হবে গুগল ও এআইনির্ভরতা যে সাংবাদিকের সৃষ্টিশীলতা ও নিজস্বতা নষ্ট করে না ফেলে। কপি পেস্ট যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।

সাংবাদিকতার মান বাড়াতে পেশাগত নিশ্চয়তার কোনো বিকল্প নেই। সব ধরনের গণমাধ্যমের জন্য একটি অভিন্ন ওয়েজবোর্ড; নিয়োগ ও পদোন্নতির আধুনিক পদ্ধতি চালু; সরকারের সব ধরনের নিয়ন্ত্রণের বদলে সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি।

প্রকাশ: https://pressrights.net/the-idea-of-a-free-media-in-bangladesh-is-fundamentally-flawed/?fbclid=IwY2xjawK3ylBleHRuA2FlbQIxMQBicmlkETFMaE5TZEhwN1RFcUIyWDlBAR47CDUQjZsNtx86WfPsh6trw-h66pF_SM0baryBbd1WGvat2yWLR6eeG7iS7g_aem_G3LaNqjyQqIwgFRiXWm15A

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: শেরিফ আল সায়ার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top