সংস্কার না হলে নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় কেন লাগবে?

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি সংস্কার না চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তবে বেশি সংস্কার চাইলে আরও ছয় মাস সময় লাগবে।

প্রশ্ন হলো, সংস্কার না হলে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে কেন? যদি ডিসেম্বরেও জাতীয় নির্বাচন হয়, তাহলেও অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে ১৬ মাস। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য ১৬ মাস কি কম সময়? যদি এই সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হয়, তাহলে এমন একটি অনির্বাচিত ও অরাজনৈতিক সরকার কেন এতটা সময় ক্ষমতায় থাকবে— যাদের আন্তরিকতা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন না থাকলেও নানা ইস্যুতে অদক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

যদি সংস্কার না হয় এবং শুধু নির্বাচনই যদি এই সরকারের ম্যান্ডেট হয়, তাহলে ১৬ মাস কেন, ছয় মাসও লাগার কথা নয়। কেননা অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়েছে, ২০০৭ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদে। তারা দুই বছর (জানুয়ারি ২০০৭—ডিসেম্বর ২০০৮) ক্ষমতায় ছিল এবং সেই সময়ে নানাবিধ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আখেরে কোনো সংস্কারই হয়নি; রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসেনি; বিচার বিভাগ, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক সংস্কার তো হয়ইনি, বরং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল এবং চতুর্থ মেয়াদেও থাকার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে।

অর্থাৎ ওয়ান ইলেভেনের সময় নানাবিধ সংস্কারের যে কথা শোনা গিয়েছিল, সেই সরকার বিদায় নেওয়ার পর এমন সব ঘটনা দেশের রাজনীতিতে ঘটতে থাকল, যা দেশকে আরও পিছিয়ে দিয়েছে। এক-এগারোর সরকারের ওই দুই বছরে দেশের অর্থনীতির যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, সেটি আরেকটি অংক।

স্মরণ করা যেতে পারে, আশির দশকে এরশাদের পতনের দাবিতে যখন আন্দোলন তুঙ্গে, তখনো রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা উঠেছিল। সেই অনুযায়ী তিন জোটের রূপরেখায় রাজনৈতিক দলগুলো একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু কেবল সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া দেশের রাজনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোয় আর কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি।

অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের অংশীজনরা সংস্কার বলতে যদি শুধু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার নিশ্চিত করাকেই বোঝেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করেন কিংবা সংস্কার করতে ব্যর্থ হন; যদি সংস্কারের নামে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে; যদি সংস্কারের নামে চাঁদাবাজি-ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাটকারীদের শুধু ও দলীয় পরিচয় বদল হয়; সংস্কারের নামে যদি এখনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতিতে আগের মতোই আঞ্চলিক, দলীয়, ব্যক্তিগত সখ্যতাসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করা হয়— তাহলে সেই সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেওয়াটাই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সম্মানজনক হবে।

কেননা এক-এগারোর সরকারও সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং ওই সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত কেউই আর দেশে থাকতে পারেননি। জীবনের শেষ দিনগুলো তাদের কাটাতে হচ্ছে বিদেশের মাটিতে। অথচ সত্যিই তারা যদি দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারতেন; সত্যিই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে পারতেন; ব্যবসায়ীদের ‘সাইজ করতে’ গিয়ে দেশের অর্থনীতি বিপন্ন করে না তুলতেন; ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গণবিরোধী অবস্থান না নিতেন— তাহলে ইতিহাসে অত্যন্ত সম্মানজনক আসনে থাকতে পারতেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও পরিণতি কী হবে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে এটা ঠিক, একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকারটি গঠিত হলো, তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তারা এরইমধ্যে পাঁচ মাস অতিবাহিত করেছে। অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর জন্য যে সময়সীমা নির্ধারিত ছিল, তারচেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সময় তারা পার করেছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রের কোনো খাতে দৃশ্যমান ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে— সেটি বলার সুযোগ নেই।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কারা আছেন, সাধারণ মানুষের কাছে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন সে বাজারে গিয়ে কতটা স্বস্তি পাচ্ছে। তার জীবনযাপনের ব্যয় কতটা বেড়েছে। আবার খরচ বাড়লেও বিপরীতে যদি তার আয় বাড়ে তাতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অসংখ্য মানুষ বেকার হয়েছেন; অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে; অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের মালিক পলাতকসহ নানা কারণে কর্মীদের বেতন আটকে গেছে বা অনিয়মিত। অনেক বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানও এখন অর্থনৈতিক সংকটে খাবি খাচ্ছে।

অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে অর্থপাচারসহ নানাবিধ অভিযোগ আছে। কিন্তু তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের লাখো সাধারণ কর্মীর কী অপরাধ? তারা যে বেকার হলেন বা বেতন আটকে যাওয়ায় তাদের জীবন যে দুর্বিসহ হয়ে উঠলো, সেজন্য তারা নিজেরা কতটা দায়ী? সুতরাং যত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথাই বলা হোক না কেন, সংবিধানে যে পরিবর্তন আনার কথাই বলা হোক না কেন, অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হলে সংস্কারের সব উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে।

দেখা যাচ্ছে, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় সব বিতর্ক উসকে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে অনেকের মনেই এখন এই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে যে, জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য কি মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান তৈরি করা? যাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে, তাদের ভাষ্য ও বয়ানে এখন নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে হবে?

সরকার স্বীকার করুক বা না করুক, ৫ আগস্টের পর অপরাধ-প্রবণতা বেড়েছে। প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমে খবর আসছে। পুলিশ এখনো পুরোপুরি ফাংশন করছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যে কারণে মানুষের মধ্যে একটা দারুণ ইনসিউকরিটি ফিলিং বা নিরাপত্তার সংকট তৈরি হয়েছে।

যেকোনো রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের আগে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; বিপদাপন্ন হলে তার উদ্ধার পাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং বাজারে গিয়ে তার স্বস্তি নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত নাগরিকের এই সংস্কারগুলো নিশ্চিত করতে পারলে নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষ খুব বেশি চিন্তিত হবে না। কিন্তু যখনই সে দেখবে যে তার জীবনযাপন আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে; তার জীবিকার সংকট আগের চেয়ে বেড়েছে; যদি দেখে যে আগে অন্তত সকাল ৭টা পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যেত অথচ এখন ৭টার আগেই গ্যাস চলে যায়; সে যদি দেখে যে নানাবিধ সমালোচনার পরও বছরের প্রথম দিনেই তার সন্তানের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হচ্ছে, অথচ এখন বলা হচ্ছে মার্চের আগে সম্ভব নয়— তাহলে তার অবচেতন মনেই এই প্রশ্ন জাগবে যে, আগেই কি ভালো ছিলাম? অতএব মানুষ যেন মনে না করে যে আগেই ভালো ছিলাম— সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব অনেক। গত পাঁচ মাসে তারা সেই দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পেরেছে, সেই আত্মসমালোচনাটি দরকার।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের কথায় ফেরা যাক। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি সংস্কার না চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তার মানে ডিসেম্বরের মধ্যে কিছু সংস্কার হবে। সেগুলো কী? সাংবিধানিক সংস্কার হতে হবে পরের সংসদে। দ্বিতীয় উপায় হলো গণপরিষদ নির্বাচন দিয়ে সেখানে নতুন করে সংবিধান লেখা। কিন্তু সেটি যে এই মুহূর্তে সম্ভব নয় এবং এই ইস্যুতে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠবে না— তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়।

সুতরাং সংবিধানে যেসব পরিবর্তন বা সংশোধনের সুপারিশ আসবে, সেগুলো কার্যকর করতে হবে পরবর্তী সংসদে এবং এটি হতে হবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। অন্তর্বর্তী সরকার একটি সংলাপের মধ্য দিয়ে সেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার দরজাটি খুলে দিতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের পর যদি ক্ষমতাসীন দল সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে তাহলে কী হবে? যদি নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখা এবং ওয়ান-ইলেভেনের মতোই ‘সংস্কার’ শব্দটি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় এবং দেশ আগের মতোই চলতে থাকে— তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল তো বটেই, জুলাই অভ্যুত্থানও ব্যর্থ হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তত এই বাস্তবতাটি উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, অতীতের সরকারগুলো যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছে; দলীয়করণের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগসহ সব প্রতিষ্ঠান যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে; উন্নয়ন প্রকল্পের নামে যেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে, সেই একই তরিকায় দেশ চালাতে থাকলে মানুষ আবারও রাস্তায় নামবে এবং তাদেরও টেনে নামাবে।

প্রকাশ: ডেইলি স্টার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top