নদী সুরক্ষায় মানুষকেই পাহারাদার হতে হবে

আমাদের দেশের পরিচয় নির্ধারিত হয় প্রধানত বাংলা ভাষা ও নদী দিয়ে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরের বছর থেকেই ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই ভূখণ্ডের মানুষ রক্ত দিয়েছিল। সেই ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ভাষার ওপর দাঁড়িয়ে একটি দেশের জন্মই পৃথিবীর অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে আলাদা করেছে।

একইভাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যাকে বলা হয় ‘নদীমাতৃক’। অর্থাৎ নদী যে দেশের মা। কিন্তু সেই মা যে এ দেশের সন্তানদের হাতেই প্রতিনিয়ত নির্যাতিত, নিপীড়ত ও খুন হচ্ছে– সেটিও পৃথিবীতে বিরল।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়, চোখের সামনেই গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার লতিফপুর গ্রামের শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে চলছে বালু ভরাটের কাজ। এরই মধ্যে পাঁচ বিঘা জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। এসব জমি একটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হতে পারে। এসব কাজ দিনের চেয়ে রাতেই বেশি হয় (আজকের পত্রিকা, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।

মানুষ তার বাড়ির পাশে ১ শতাংশ জমি দখল হয়ে গেলে বা অন্য কেউ তার জমির মালিকানা দাবি করলে লাঠিসোটা নিয়ে নেমে পড়ে; আদালতে যায়। কিন্তু ১ শতাংশ জমি হারানোর চেয়ে একটি নদী হারিয়ে যাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি মূল্য যে কয়েক হাজার গুণ– এই বোধটুকু তার ভেতরে জাগ্রত হয় না। চোখের সামনে তার নদী দখল হয়ে গেলে সে চুপ থাকে। কারণ, সে ওই নদীর মালিকানা নিজের বলে মনে করে না।

সুতরাং মানুষ যখন এটি বিশ্বাস করতে শিখবে– তার বাড়ি, উঠোন ও ফসলের জমির মালিকানা যেমন তার এবং এই জমিতে অন্য কারও দখলদারিত্ব যেমন সে সহ্য করে না; তেমনি নদীর মালিকানাও তার। ওই নদী কেউ দখল করে অবকাঠামো নির্মাণ করলে; কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলে ওই নদীর পানি কেউ দূষিত করলে এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটা করতে হবে নদীপাড়ের মানুষকেই।

একজন প্রধানমন্ত্রী, একটি নদীরক্ষা কমিশন কিংবা একটি বিআইডব্লিউটিএর পক্ষে দেশের সব নদী পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। স্থানীয় প্রশাসনও বেশি কিছু করতে পারবে না, যদি নদীপাড়ের লোকেরা নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার না থাকে।
যারা নদী দখল করে বা কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলে নদীদূষণ ঘটায়; নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান। যে ক্ষমতা তাকে সামাজিকভাবে ক্ষমতায়িত করে এবং ওই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা তাকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে যায়। নানা উসিলায়, নানা নামে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়। ফলে অনেক সময় এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র চুপ থাকে।

অনেক বড় শিল্পোদ্যোক্তা নদীর জায়গা দখল করে সেখানে বড় বড় কারখানা গড়ে তোলেন। ওই কারখানায় প্রচুর সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়; ওইসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দেশের মানুষের কাজে লাগে; ওইসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়; সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে; ইত্যাকার কারণে অনেক সময় প্রভাবশালী নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে চুপ থাকতে দেখা যায়।

কিন্তু বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পরিচয় নদীর অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়ে কোনো উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান; কোনো রপ্তানিই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী না থাকলে এই দেশটিও থাকবে না। বাংলাদেশ বিপন্ন হলে নদী দখলদার শিল্পপতিরা হয়তো প্লেনের টিকিট করে উড়াল দেবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষকে এ দেশেই থাকতে হবে। দেশ বিপন্ন হলে তাদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সুতরাং সেই সাধারণ মানুষকেই এখন নদীর পাহারাদার হতে হবে।

যেসব এলাকার নদী দখল হয় এবং কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হয়; সেসব নদীপাড়ের সাধারণ মানুষকেই তার নিজের ও পরবর্তী প্রজন্মের বেঁচে থাকার স্বার্থে নদীর পাহারাদার হতে হবে। যেহেতু রাতে মানুষের চলাচল ও ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে অসাধু লোকেরা নদীতে বালু, ময়লা ও ইট-সুরকি ফেলে ধীরে ধীরে দখল করে; তাদের প্রতিহত করতে রাত জেগে নদী পাহারা দিতে হবে। ঘুম বিসর্জন দিতে হবে। কেননা, নদী না থাকলে আপনি নিজেই এক সময় ঘুমাতে পারবেন না।

প্রকাশ: সমকাল, ১০ মার্চ ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top